হৃদরোগ (সিভিডি) হলো হৃদপিণ্ডের রক্তনালীগুলোর কার্যকারিতার সাথে সম্পর্কিত একটি অবস্থা। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো হৃদরোগ। বিশ্বজুড়ে অর্ধ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত।
ওয়ার্ল্ড হার্ট রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে ২০.৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হৃদরোগ, যা বিশ্বব্যাপী সব মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশের কাছাকাছি। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, অস্বাস্থ্যকর খাবার, বায়ু দূষণ, স্থূলতা, তামাকের ব্যবহার, কিডনি রোগ, কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করা, অ্যালকোহলের ক্ষতিকর ব্যবহার এবং মানসিক চাপ ইত্যাদি কারণগুলো হৃদরোগের জন্য দায়ী করা হয়।[১]
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে হৃদরোগ (সিভিডি) হলো হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালী সংক্রান্ত একগুচ্ছ ব্যাধি। এর মধ্যে রয়েছে, করোনারি হার্ট ডিজিজ—হৃৎপিণ্ড থেকে পেশিতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীগুলোর রোগ। সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ—মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীগুলোর রোগ।
পেরিফেরাল ধমনি রোগ—বাহু এবং পায়ে রক্ত সরবরাহকারী ধমনির রোগ। রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ—স্ট্রেপ্টোকক্কাল ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রিউম্যাটিক ফিভার থেকে হৃদপিণ্ডের পেশি এবং ভালভের ক্ষতি। জন্মগত হৃদরোগ—এই রোগে জন্ম থেকেই হৃদপিণ্ডের গঠনের ত্রুটির কারণে হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক বিকাশ এবং কার্যকারিতা ব্যাহত হয় এবং ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস ও পালমোনারি এমবোলিজম—পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বাঁধে, যা হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসে চলে যেতে পারে।[২]
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সিভিডির প্রকোপ বাড়ছে। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে এর ব্যাপকতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় হৃদরোগের (সিভিডি) উত্থান অনেকাংশে নগরায়নের সাথে সম্পৃক্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের অধিবাসীদের মাঝে গ্রামীণ অধিবাসীদের তুলনায় সিভিডির ঝুঁকি বেশি। তবে সময়ের সাথে এই ঝুঁকিগুলো কীভাবে বিকাশ লাভ করে সেই সম্পর্কে আমরা দৃষ্টিপাত করি না।
প্রাথমিকভাবে দেখা যায় শহরে আসা অভিবাসীদের স্বাস্থ্য শহরে বসবাসরত জনসংখ্যার তুলনায় বেশ ভালো তবে, বাসস্থানের পরিবর্তনের সাথে, অভিবাসীরা শহরের খাদ্য এবং অন্যান্য জীবনধারার (যেমন, কায়িক পরিশ্রম না কারা) সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যা সিভিডির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের ঠিক পরে শরীরের চর্বি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যেখানে অন্যান্য কার্ডিওমেটাবলিক ঝুঁকির কারণগুলো ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। যাইহোক, এই প্রক্রিয়াটি ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীতে ভিন্ন ভিন্ন হয়, কারণ পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের অবস্থার মধ্যে সম্পর্ক জটিল।[৩]
পুরুষের তুলনায় মহিলাদের হৃদরোগ কম হওয়ার কারণ হলো তাদের যৌন হরমোন ইস্ট্রোজেন। এটি তাদের জন্য প্রতিরক্ষামূলক হিসাবে কাজ করে। কিন্তু যেসব মহিলা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তারা এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে চলে আসেন এবং অধিক হারে হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে আরও একটি মারাত্মক ঘটনা ঘটে, আর তা হলো ডায়াবেটিস রোগীরা অনেকে হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা অনুভব করতে পারেন না। প্রায়শই এ কারণে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়ে যায় বা আদৌ শুরু করা হয় না। ফলে তারা মারাত্মক জটিলতায় ভোগেন এবং অধিক হারে মৃত্যুবরণ করেন।[৪]
নারীদের হৃদরোগের লক্ষণ পুরুষের থেকে আলাদা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ জানান, নারীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হলে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব নাও করতে পারেন। সেইক্ষেত্রে বুক ভারী হওয়া, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা বা উদ্বিগ্নতা বোধ করা, হাত অথবা কাঁধে অস্বস্তি, মাথা ঘোরা, পেটে অস্বস্তি, বমি বমি ভাব ইত্যাদি উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো এ লক্ষণগুলো অন্যান্য শারীরিক সমস্যাতেও দেখা যায়, এ কারণে নারীরা হৃদরোগের উপসর্গ অনেক সময় বুঝতে পারেন না।
আবার স্বভাববশত বেশিরভাগ নারীই নিজেদের সমস্যা চাপা দিয়ে রাখেন এবং রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দেরি না হওয়া পর্যন্ত তাদের মধ্যে সমস্যাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখা যায়। আর্থ-সামাজিক কারণেও নারীদের নিজের সমস্যা উপেক্ষা করতে দেখা যায়। অন্যান্য আরও কিছু কারণও রয়েছে যা নারীদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
ডায়াবেটিস, মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ, ধূমপান, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, মেনোপজ, গর্ভাবস্থার জটিলতা, হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকা, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং লুপাসের মতো প্রদাহজনক রোগ নারীদের মধ্যে হৃদরোগের জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। যেসব নারীরা একই সঙ্গে জন্মবিরতিকরণ পিল ও ধূমপান করে থাকেন তাদের হৃদরোগর আশঙ্কা বেশি থাকে।
বিশেষ করে যাদের বয়স ৩৫ বছরের বেশি, তাদের ঝুঁকিটাও থাকে আরও বেশি। ধূমপান বন্ধ করে দিলে হৃদরোগর আশঙ্কা কমে শতকরা আশি ভাগ। নিয়মিত মদ্যপান বাড়িয়ে দেয় হৃদরোগর ঝুঁকি। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, অতিরিক্ত ওজনের মতো সমস্যা ডেকে আনে অতিরিক্ত মদ্যপান, যা সংবহনতন্ত্রের জন্য মোটেও ভালো নয়।
হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচরণগত ঝুঁকির কারণগুলো হলো অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, শারীরিক পরিশ্রম কম করা, তামাক ব্যবহার এবং অ্যালকোহলের ক্ষতিকারক ব্যবহার। আচরণগত ঝুঁকির কারণগুলোর প্রভাব ব্যক্তির মধ্যে রক্তচাপ বৃদ্ধি, রক্তে গ্লুকোজ বৃদ্ধি, রক্তের লিপিড বৃদ্ধি, অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই ঝুঁকিগুলো পরবর্তীতে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিওর এবং অন্যান্য জটিলতার বর্ধিত ঝুঁকি নির্দেশ করে।
নারীরা সারাদিনে অনেক দায়িত্ব পালন করেন। যার জন্য ব্যায়াম করার সুযোগ পান না। পর্যাপ্ত শরীরচর্চার অভাবও সংবহনতন্ত্রের সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের সপ্তাহে অন্তত আড়াই ঘণ্টা শরীরচর্চা করা উচিত।
যারা শরীরচর্চা করতে পারেন না, তাদের প্রতিদিন অন্তত তিরিশ মিনিট হাঁটতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের দেখাশোনা করতে গিয়ে নারীরা নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি তেমন খেয়াল করেন না। সংসার জীবন হোক আর কর্মক্ষেত্রে হোক নারীদের অনেক রকম দুশ্চিন্তা করতে দেখা যায়। তারা একাধিক সমস্যা নিজেদের মনে ও শরীরে বয়ে চলেন।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞগণ বলেন, এসব কারণে নারীর শরীরে এমন কিছু হরমোনের আবির্ভাব হয় যা হৃদরোগের কারণ হতে পারে। এছাড়া ঠিকমতো ঘুম না হওয়াও বড় অনুঘটক হতে পারে হৃদরোগের। তাই সুস্থ থাকতে ৭/৮ ঘণ্টার শান্তির ঘুম খুব প্রয়োজন।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যা থাকলে নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। বাহ্যিক উপসর্গ না থাকলেও এই বিষয়গুলো নজরে না রাখলে ঘটতে পারে বিপদ। যাদের এ ধরনের সমস্যা আছে, তাদের নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।
তামাক ব্যবহার বন্ধ করা, খাবারে লবণের পরিমাণ কমানো, বেশি করে ফল ও শাকসবজি খাওয়া, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা এবং অ্যালকোহলের ক্ষতিকর ব্যবহার এড়িয়ে চললে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায় এমনটাই জানিয়েছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞগণ।
সেইসাথে মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকা দরকার। অবসরে বই পড়ে, গান শুনে বা সিনেমা দেখে নিজেকে প্রফুল্ল রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নারীর নিজের যেমন দায়িত্ব আছে নিজর জন্য সময় বের করে নিজেকে ভালো রাখার তেমনি পরিবারের অন্য সদস্যদেরও উচিৎ এ ব্যাপারে নারীকে সাহায্য করা।
যাদের সিভিডির সর্বোচ্চ ঝুঁকি রয়েছে তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে, অকাল মৃত্যু রোধ করা যেতে পারে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় অসংক্রামক রোগের ওষুধসহ সমস্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলো এবং সেইসাথে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং পরামর্শ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে আমরা সকলেই হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারি এবং আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারি।
Reference:
- World Heart Federation. World Heart Report [Internet]. Available from: https://world-heart-federation.org/wp-content/uploads/World-Heart-Report-2023.pdf
- Cardiovascular diseases [Internet]. [cited 2023 Sep 21]. Available from: https://www.who.int/health-topics/cardiovascular-diseases
- Mumu SJ, Stanaway FF, Merom D. Rural-to-urban migration, socio-economic status and cardiovascular diseases risk factors among Bangladeshi adults: A nationwide population based survey. Front Public Health [Internet]. 2023 [cited 2023 Sep 19];11. Available from: https://www.frontiersin.org/articles/10.3389/fpubh.2023.860927
- DM-Heart-Diseases.pdf [Internet]. [cited 2023 Sep 17]. Available from: http://shahjadaselim.com/wp-content/uploads/2017/04/DM-Heart-Diseases.pdf
ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার ।। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট