অর্থ-বাণিজ্য

টনিক আতঙ্কে ড্রাগন ফল বিক্রিতে ‘ধস’

dragon-pickynews
পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে টনিকযুক্ত ফল ক্ষতিকর, এমন কোনো বার্তা দিতে চায় না নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

যেসব ড্রাগনের কিছু অংশ সবুজ ও কিছু অংশ লাল, সেগুলোর চাষে হরমোনের ব্যবহার আছে-এমনটাই বলা হচ্ছে।

দেশে উৎপাদন শুরু হওয়ায় কয়েক বছর ধরেই বাড়ছিল ড্রাগন ফলের জনপ্রিয়তা, কিন্তু ‘টনিক’ ব্যবহার বিতর্কে সেই বিদেশি ফলটির বিক্রিবাট্টা তলানিতে নেমেছে।

বিক্রেতারা বলছেন, ড্রাগন ফলে হরমোন প্রয়োগের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ‘সূত্রবিহীন খবর’ সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর ফলটি কিনতে চাইছেন না অনেকে।

তাতে করে যেসব চাষি সাধারণ পদ্ধতিতে (হরমোন ছাড়া) ড্রাগন ফল উৎপাদন করেছেন, তারাও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

টনিকযুক্ত ড্রাগন নিয়ে ধোঁয়াশা দূর করা না গেলে সম্ভাবনাময় এ ফলটি বাজার হারাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিক্রেতাদের অনেকে।

টনিক বিতর্কে ড্রাগন আর আগের মতো বিক্রি হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন বিক্রেতারা

সোশাল মিডিয়ার ‘খবরটি’ ধারণানির্ভর হলেও ড্রাগন ফলে আসলেই টনিকের ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে চাইছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। দেশের ভেতরে থাকা ল্যাবরেটরির পাশাপাশি প্রয়োজনে বিদেশে টনিকযুক্ত ড্রাগন ফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মেহেদি মাসুদ দাবি করছেন, ড্রাগনের ফলন বৃদ্ধি করতে যে টনিক বা ফাইটোহরমোন ব্যবহার করা হচ্ছে, তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা নেই।

“কিছু ইউটিউবারের অপপ্রচার থেকে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে; অজ্ঞতার কারণে এই অপপ্রচারটা ছড়িয়ে পড়েছে।”

সোশাল মিডিয়া থেকে যা ঘটেছে

একটি বেসরকারি টিভির ইউটিউব চ্যানেলে ‘ড্রাগন ফল খাচ্ছি নাকি বিষ খাচ্ছি?’ শিরোনামে ৪ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে জীবন রয় নামের এক কৃষিবিদের ফেইসবুক পোস্টকে উদ্ধৃত করে কয়েকজন ভোক্তার ‘নেতিবাচক’ বক্তব্য প্রচার করা হয়।

সম্প্রতি আরও অন্তত তিনটি টিভি চ্যানেলের ইউটিউব পেইজে ড্রাগনে হরমোনের ব্যবহার নিয়ে সচেতনতামূলক প্রতিবেদন করা হয়। এসব প্রতিবেদনে বড় আকৃতির ড্রাগন ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রসঙ্গটি উঠে আসে।

এমটি ওয়ার্ল্ড নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘ড্রাগনের নামে কি নামে কি খাওয়াচ্ছেন আপনার সন্তানকে জানেন কি…’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, টনিকযুক্ত বড় আকারের ড্রাগন খেলে মানুষের ‘ডিএনএ পরিবর্তন’ হয়ে যেতে পারে।

সোশাল মিডিয়ায় ড্রাগন ফল নিয়ে একটি ঘটনা এসেছে নড়াইল এক্সপ্রেস নামের একটি ফেইসবুক পেইজে। সেখানে ভ্যান গাড়িতে ফেরি করে ড্রাগন ফল বিক্রি করা একজনকে হেনস্তা করতে দেখা যায় একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরকে। গত ৪ ডিসেম্বরে আপলোড করা ওই ভিডিও ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দেড় কোটি ফেইসবুক ব্যবহারকারীর কাছে ছড়িয়ে পড়েছে।

চাহিদা ভালো থাকায় ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়

এর মধ্যে গত ১০ ডিসেম্বর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে রোজা উপলক্ষে খেজুরসহ অন্যান্য ফলের সরবরাহ নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে ড্রাগন ফল বিক্রি নিয়ে দুর্দশার কথা তুলে ধরেন বিক্রেতারা। ক্রেতারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় দিনের পর দিন অপেক্ষার পর নষ্ট হয়ে যাওয়া ড্রাগন ফল ফেলে দিতে হয়েছে বলেও জানান কেউ কেউ।

সম্প্রতি মিরপুর-১০ নম্বর চত্বর এলাকার ফল ব্যবসায়ী জহির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ড্রাগনের মধ্যে মেডিসিন দেওয়া হইছে এমন খবরে বিক্রি কমে গেছে। আজকে ১৫/২০ দিন ধরে এই পরিস্থিতি। আগে যেটা কেজি ৩০০ টাকা থেকে সাড়ে ৩০০ টাকায় বিক্রি হতো সেটা এখন আড়াইশ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আমাদের অনেক টাকা লস হইছে।

“যেই দামে বিক্রি করছি, সেটা আমাদের কেনা দামের চেয়েও কম। পাইকারিতেও দাম কমে কেজি দেড়শ থেকে ২০০ টাকায় নেমেছে, যেটা আগে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা ছিল।”

বিক্রি কমে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “আগে দৈনিক ৩০/৪০ কেজিও বিক্রি হয়ে যেত। এখন সারাদিনে ৫ কেজিও বিক্রি করা যাচ্ছে না। মানুষজন ড্রাগনে হাতই দিচ্ছে না।

“এখন আসলেই ড্রাগনে কী সমস্যা, সেটা তো আমরা জানি না। ভালো-খারাপ কোনোটাই জানি না। কৃষক উৎপাদন করে, আর আমরা কিনে এনে বিক্রি করি।”

আরেক বিক্রেতা মনজিল শেখ বলেন, “এখন ড্রাগন বিক্রির দিকে আমাদের মনোযোগ নেই। আমরা এখন অন্যান্য ফল বিক্রি করছি। আগে যেখানে দৈনিক এক মণ ড্রাগন বিক্রি হত, এখন ৩/৪ কেজিও বিক্রি হচ্ছে না।”

ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রতিকেজি ড্রাগন ফল পাওয়া যাচ্ছে ১৫০ টাকায়।

বছরের মে মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ড্রাগনের ফলন হয়। নভেম্বরে এসে ফলটির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দামও কিছুটা বেড়ে যায়। যদিও এবার বিরূপ প্রচারের মুখে দাম পড়ে গেছে।

ড্রাগন নিয়ে হইচই কেন

সরকারি কৃষি বাতায়নের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০৭ সালের দিকে থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে ড্রাগন ফলের বিভিন্ন জাত এনে চাষাবাদ শুরু হয়। এর আগে ঢাকায় স্বল্প পরিসরে আমদানি করা ড্রাগন পাওয়া যেত। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত ড্রাগন ফলের নতুন জাতটি হলো বারি-১।

এ ফলের আকার বড়, পাকলে খোসার রঙ লাল হয়ে যায়, শাঁস গাঢ় গোলাপি রঙের, লাল ও সাদা এবং রসাল প্রকৃতির। ফলের ওজন ১৫০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এখন লাল ড্রাগন ফল বা পিটাইয়া, কোস্টারিকা ড্রাগন ফল, হলুদ রঙের ড্রাগন ফল এবং ভারতে উদ্ভাবিত বিভিন্ন ড্রাগনের চাষাবাদ হয়।

এছাড়া বারি ড্রাগন ফল-১, বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা), বাউ ড্রাগন ফল-২ ( লাল ), বাউ ড্রাগন ফল-৩ নামের বিভিন্ন প্রজাতির চাষাবাদও হচ্ছে।

লাল রঙের এ ড্রাগন দেখে ভোক্তারা অভ্যস্ত হলেও গত দুই বছর ধরে বড় আকারের ড্রাগনও বাজারে দেখা যাচ্ছে

গত এক দশক ধরে মানুষ ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের ও ভেতরে-বাইরে টুকটুকে লাল রঙের ড্রাগন দেখে অভ্যস্ত হলেও গত দুই বছর ধরে বড় আকারের ড্রাগনও বাজারে দেখা যাচ্ছে। ফলনবর্ধক এক ধরনের ‘প্রাকৃতিক হরমোন’ ব্যবহারের ফলে ফলের ওজন ও আকার দ্বিগুণেরও বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মেহেদি মাসুদ।

তিনি বলেন, বড় আকারের ড্রাগন চাষিদেরকে অধিক মুনাফার একটা পথ তৈরি করে দিয়েছে।  এমন ড্রাগনের ওজন ১৩০০ গ্রামও হওয়ায় অনেকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে।

ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মেহেদি মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কিছু ইউটিউবারের অপপ্রচার আর অজ্ঞতার কারণে’ ড্রাগন ফল নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

“ড্রাগন ফল খাওয়ার ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধ, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হওয়াসহ নানারকম শারীরিক উপকার হয়। তারা উল্টো প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, ড্রাগন খেলে ক্যান্সার হবে।”

যেই টনিক বা ফাইটোহরমন বা পিজিআর (প্লান্ট গ্রোথ রেগুলেটর) ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে তা ‘মোটেও ঠিক নয়’ বলে দাবি করেন মেহেদি মাসুদ।

তিনি বলেন, “এগুলো প্রধানত জিবরেলিক এসিড থ্রি। জিএ৩, জিএ৪, জিএ৭- এগুলো ফাইটোহরমোন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ফাইটোহরমোনটা সাধারণত গাছ থেকেই জন্মায়, ন্যাচারাল। এগুলোকে বলে অর্গানিক সাবস্টেন্স, যা কখনও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে না। এগুলো অ্যাসিড হিসাবে এতই দুর্বল যে, মানুষের শরীরে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না।”

উদাহরণ হিসাবে প্রচলিত ভিনেগারের প্রসঙ্গ টেনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মেহেদি মাসুদ বলেন, “৪ থেকে ১০ শতাংশ এসিটিক অ্যাসিডকে ভিনেগার বলে। কিন্তু এই এসিটিক অ্যাসিড যখন ফাইটোহরমোন হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তখন এর মাত্রা হয় দশমিক ০৩ শতাংশ। সালাদ, ফাস্টফুড, মাছ ভাজি এমনকি শরবত তৈরিতেও ভিনেগার ব্যবহার হচ্ছে।”

১৯২৬ সালে জিবরেলিক অ্যাসিড হরমোন হিসাবে প্রথম শনাক্ত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া সব উন্নত দেশে ফাইটোহরমোন ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশে পৌঁছাতে অন্তত ৯ দশক সময় লেগে গেছে। আপেল, চেরিফল, আঙ্গুর- এগুলো জিবরেলিক অ্যাসিডের প্রয়োগ ছাড়া তৈরি হচ্ছে না। আমাদের দেশে আমরা তো এসব ফল দিব্যি খাচ্ছি। আবার বাংলাদেশে উৎপাদিত ড্রাগন ফলও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।”

মেহেদি মাসুদ বলেন, “আমরা চাষি ভাইদের বলেছি ৫০ পিপিএম থেকে ৩০০ পিপিএমের মধ্যে ফাইটোহরমোন ব্যবহার করার জন্য। জৈব সার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান যদি ঠিক থাকে, তাহলে দ্বিগুণ ফলন পাওয়া সম্ভব। মালয়েশিয়ায় ২০১৪ সালে, ভিয়েতনামে ২০২২ সালে টনিক নিয়ে গবেষণা হয়েছে।

“এগুলো এশিয়ান জার্নাল ফর এগ্রিকালচারে প্রকাশ হয়েছে। তারা একই রকম ফলাফল পেয়েছে। কেউ যদি বেশি ব্যবহার করে, তাহলে সেটা হবে অপচয় এবং গাছের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। তাই উপযুক্ত পরিমাণে টনিক বা হরমোন ব্যবহারের ফলে কৃষক লাভবান হবেন।”

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ফল বিভাগ) উবায়দুল্লাহ কায়ছার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ড্রাগন ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি পত্রপত্রিকা ও টিভির প্রতিবেদনের আমাদের নজরে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে বাজার থেকে বড় আকারের ড্রাগন সংগ্রহ করে আমরা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছি।

“প্রয়োজনে দেশের বাইরের ল্যাব থেকেও এটা পরীক্ষা করানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। হরমোন প্রয়োগের ফলে ফলের পুষ্টিগত মান পরিবর্তন হয়েছে কি না এবং এই ফল খাওয়ার ফলে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয় কি না- সেটাই দেখা হচ্ছে।”

তবে টনিকযুক্ত ড্রাগন ফল কিনে ভোক্তারা যে আর্থিকভাবে ঠকছেন তা ফেইসবুকে তুলে ধরেছেন আনিসুর এএফ রেহমান নামের এক চাষি।

তার ভাষ্যে, “যদি ধরেও নিই টনিকে ১%ও ক্ষতি নাই, তারপরেও একজন ক্রেতা কেন ফলের দামে অপ্রয়োজনীয়, অখাদ্য খোসা যা কিনা ৫০% বা তারও বেশি কিনবে? বলেন, আপনারাই বলেন। মাত্র একটা যুক্তি দেখান। আর টনিকযুক্ত ফলের স্বাদের বিবরণ না হয় নাই দিলাম।

“আমার গাছের ফল খাইয়ে আমার পরিবার এবং আমার অনেক স্বল্প পরিচিত লোককে আবার ড্রাগন খাওয়ার প্রতি আগ্রহী করেছি। তারা কেনা ফলের বিস্বাদের কারণে প্রথমে আমার নিজের উৎপাদিত গাছপাকা ফল খেতেও যথেষ্ট দ্বিধাবোধ করেছিল।”

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যা বলছে

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গত ১২ ডিসেম্বর অংশীজন বৈঠক করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ফল বিভাগ) উবায়দুল্লাহ কায়ছার, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেইফটি ল্যাবরেটরির কর্মকর্তা রিজওয়ানা শারমীন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হার্টিকালচার উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক কে জে এম আব্দুল আওয়াল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইকবাল রউফ মামুন, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল হাসনাত মু. সোলায়মানসহ অন্য বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন।

হরমোন দিয়ে বড় করা ড্রাগন ফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে কোনো নেতিবাচক বার্তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ওই বৈঠকে নেওয়া হয় বলে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন। বৈঠকে হরমোনযুক্ত ড্রাগন ফল একাধিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (আইন ও নীতি) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হরমোন দেওয়া হয়নি, একবার হরমোন দেওয়া হয়েছে এবং একাধিকবার হরমোন দেওয়া হয়েছে- এমন ধরনের ড্রাগন ফল সংগ্রহ করে আমরা পরীক্ষা করে দেখব। সেখানে পুষ্টিগুণের কোনো পরিবর্তন আসছে কি না কিংবা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো বিষয় ঘটছে কি না, সেটাই আমরা পরীক্ষা করব। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে এই ফল ক্ষতিকর এমন কোনো বার্তা আমরা দিতে চাই না।

“তবে মোটাদাগে খালি চোখে যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা গেছে তাহল, ড্রাগনের সাধারণ আকার ৩৫০ গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হলেও এক বা একাধিকবার হরমোন প্রয়োগের ফলে এর আকার প্রতিটি এককেজি থেকে ১২০০ গ্রামও হচ্ছে। ড্রাগনের খোসা সাধারণত লাল রঙের হয়ে থাকলেও হরমোনযুক্ত ড্রাগনের ক্ষেত্রে কিছু অংশের রঙ সবুজ ও কিছু অংশের রঙ লাল আসছে।

“আরেকটা বিষয় দেখা যাচ্ছে- হরমোনমুক্ত ড্রাগনের ৮০ শতাংশই খাওয়া যাচ্ছে, খোসার অংশে থাকছে ২০ শতাংশ। আর হরমোনযুক্ত বড় ড্রাগনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ খাওয়া যাচ্ছে বাকি ৪০ শতাংশ খোসা বাবদ চলে যাচ্ছে।

বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাগানে যেসব হরমোন ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলো সরকারি নিয়ম মেনে আমদানি হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

“তাই এই বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য চেয়ে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে ফলফলাদিতে হরমোন ব্যবহারের একটি নির্দেশিকা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছি। এর অর্থ হচ্ছে কোন ফলে কী পরিমাণ বা মাত্রায় হরমোন ব্যবহার করা যাবে- সেই বিষয়ে। সাধারণ সার, কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দেশনা আছে, কিন্তু হরমোনের ক্ষেত্রে নির্দেশিকা নেই।”

কৃষি তথ্য সার্ভিসের আমিনুর ইসলাম জানান, যেসব ড্রাগনের কিছু অংশ সবুজ ও কিছু অংশ লাল, সেগুলোতে হরমোন দেওয়া হয়েছে বলে চিহ্নিত করা যায়।

“তবে হরমোনের ফলে এতে কোনো ক্ষতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বলে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য নেই।”

ড্রাগনই ‘সবচেয়ে লাভজনক’ ফল

চুয়াডাঙ্গা জেলার ড্রাগন চাষী রবিউল আলম জানান, প্রতিবছর মে মাস থেকে ড্রাগনের ফলন আসতে শুরু করে। টানা ছয়মাস ধরে ফলন উত্তোলন করা যায়। গরমের সময় ফুল আসার ২৮ থেকে ৩২ দিনের মধ্যে ফলন পাওয়া যায়।

শীতের মওসুম শুরু হলে ফলন নামাতে ৪৫ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। কোনো ধরনের হরমোন প্রয়োগ না করলে একটি ড্রাগন ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম হয়। আর হরমোন দিতে পারলে সেগুলো এক কেজি থেকে ১৩০০ গ্রাম পর্যন্ত বাড়তে পারে।

চুয়াডাঙ্গায় ১৩ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করছেন রবিউল। প্রতিবিঘা জমিতে শ্রমিক খরচ, সার-ওষুধ, জমির লিজ খরচসহ সব খরচ মিলিয়ে বছরে এক লাখ টাকা থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হলেও ড্রাগন বিক্রি শেষে বছরে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লাভ হচ্ছে বলে জানান তিনি।

রবিউল বলেন, ফুল আসার পর শীতের সময় ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর পর এবং গরমের সময় ২৮ থেকে ৩০ দিন পর ড্রাগন বিক্রি করা যায়। বছরে টানা সাত মাস ড্রাগন বিক্রি করা যায়। ইদানীং কেউ কেউ লাইটিং পদ্ধতিতে ১২ মাসই ড্রাগন উৎপাদন করে সফল হচ্ছেন। ড্রাগন বাগানে এক ধরনের এলইডি লাইট বসালে নভেম্বরের পরেও মাসে মাসে ফলন আসে।

নাটোরের ড্রাগন চাষী গোলাম মাওলা জানান, নভেম্বরের শুরু থেকেই ড্রাগন ফলের মওসুম শেষ হয়েছে। বাজারে এখন যেসব ড্রাগন ফল আছে, এর বেশির ভাগই হরমোনযুক্ত। যেসব ড্রাগনে হরমোন দেওয়া হয়, এর রঙ ভিন্ন থাকে।

“ড্রাগন লাল রঙের ফল হলেও হরমোন দেওয়ার ফলে এর রঙ কোথাও লাল কোথাও সবুজ থাকে।”

২০১৪ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রথমবারের মতো ড্রাগন ফলের আবাদ বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন দেশে ড্রাগন ফল উৎপাদন হত মাত্র ৬৬ টন। প্রকল্প থেকে সারাদেশে পাঁচ হাজার প্রদর্শনী দেওয়া হয়। সেগুলো বাস্তবায়নের ফলে এখন দেশে এক হাজার হেক্টর জমি থেকে ২৫ হাজার ৭০০ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এবছর দেশে উৎপাদিত ড্রাগন ফল সুইডেন, ফিনল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ল্যাব টেস্টেও এই ফল উত্তীর্ণ হয়েছে।

ড্রাগনই এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে লাভজনক ফল মন্তব্য করে কৃষিবিদ মেহেদি মাসুদ বলেন, “এটাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তৎপরতা শুরু হয়েছে। এই সমস্ত ইউটিউবারের পেছনে কারা আছে আমার জানা নেই। এদের আইনের আওতায় আনা উচিত। ড্রাগনের উৎপাদন খরচ কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা হয়।

“প্রতিকেজি ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করতে পারলেও ড্রাগন ফল বাংলাদেশে লাভজনক হবে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে শুরু করে পাহাড়ি অঞ্চলে ড্রাগন চাষ ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, “রাঙামাটিতে ১০ শতাংশ জমিতে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম। ওই কৃষকের এখন ৪০০ শতাংশ জমিতে চাষ হচ্ছে। এই রকম নাটোরে গোলাম নবী নামের একজন কৃষকের জমিতে প্রদর্শনী করা হয়েছিল। তিনি এখন ৩০ বিঘা জমিতে চাষ বিস্তার করেছেন।

“নাটোরে আরেকজন কৃষক গোলাম মাওলা, তিনিও প্রায় এক একর জমিতে ড্রাগন চাষ করছেন। টাঙ্গাইলের মধুপুর, ভালুকার বিস্তৃর্ণ এলাকায় এখন ড্রাগন চাষ হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গার চাষী রবিউল এবার ৭৫ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করেছেন।”

 

 

Related posts

বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী মিয়ানমার

Samar Khan

TVS Metro Plus 110 – বাংলাদেশে নতুন চালু হয়েছে

Megh Bristy

সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসসিএল টিআরপি সেবা দেবে

Rubaiya Tasnim

Leave a Comment