বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন ৩৫ বছর বয়সী সায়েদা আরেফিন (ছদ্মনাম)। তিনি দুই সন্তানের মা। গত কয়েক দিন ধরে স্তনে একটি ছোট চাকা টাইপের কিছু একটা অনুভব করছেন তিনি। সাথে সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন স্বামীর সাথে। তারপর ওই দিন সন্ধ্যায় যান পারিবারিক এক গাইনোলজিস্টের কাছে। তিনি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিলেন।
টেস্ট রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বুঝা গেল সায়েদার ব্রেস্টে একটি টিউমার। তবে তা এখনো ছোট। এরপর চলতে থাকে চিকিৎসা।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সাত হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে মারা যান এবং নতুন করে আক্রান্ত হন অন্তত ১৩ হাজার। স্তন ক্যান্সার হলেও আমাদের দেশের অনেকে লজ্জা ও টাকার অভাবে চিকিৎসকের কাছে যান না। অনেকে আবার কবিরাজের কাছে যান।
স্তন ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি নির্ণয় করতে পারলে এ রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করতে প্রয়োজন সচেতনতা। বাড়িতে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা আর মাঝে মাঝে স্ক্রিনিং করা যেতে পারে।
ব্রেস্ট অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিষেশজ্ঞ ডা. মুন্নি মমতাজ জানান, ২০ বছর বয়স থেকে প্রতিমাসে একবার নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা উচিত। নিজের স্তনে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রতিমাসে একবার, ঋতুমতী নারীদের মাসিক শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা করলে ভালো হয়। কারণ, ওই সময় স্তন কিছুটা হালকা থাকে এবং ব্যথা কম হয়।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত পরিষ্কার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পর্যাপ্ত আলোয় নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য করতে হবে। দু’বাহু দেহের দু’পাশে ঝুলিয়ে রাখুন। বাহুদ্বয় মাথার ওপরে বা পেছনে উঁচিয়ে ধরতে হবে। দু’হাত কোমরে চাপ দিয়ে দাঁড়াতে হবে, যেন বুকের মাংসপেশি টানটান হয়। স্তন বৃন্ত হালকা করে একটু চাপ দিয়ে দেখতে হবে কোনো রস বের হয় কি-না। লক্ষ করতে হবে স্তনের আকার, আকৃতি ও রঙের কোনো পরিবর্তন, দুই স্তনের কোনো তারতম্য, স্তনের ত্বকের কোনো পরিবর্তন, স্তনবৃন্ত ভেতরে দেবে গেছে কি-না, বৃন্তসংলগ্ন এলাকায় ত্বকের অস্বাভাবিকতা আছে কি-না এবং স্তনবৃন্ত থেকে নির্গত তরলের রং। দ্বিতীয়ত, হাত দিয়ে স্তন পরীক্ষা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বিছানায় শুয়ে ডান হাত দিয়ে বাঁ স্তন এবং বাঁ হাত দিয়ে ডান স্তনে হাত দিয়ে দেখুন। যে পাশের পরীক্ষা করতে হবে, ওই পাশের হাত মাথার ওপরে রাখতে হবে, কাঁধের নিচে ছোট বালিশ বা তোয়ালে ভাঁজ করে দিতে হবে, যেন বুক ও স্তন একই সমান্তরালে থাকে। অন্য পাশে অল্প কাত হয়ে শুতে হবে। এবার তিন আঙুলের প্যাড দিয়ে প্রথমে একটু হালকা চাপ, পরে আরো ভারী চাপ, এরপর আরো চাপ দিয়ে স্তন সীমানার পুরো এলাকা অনুভব করতে হবে। গোসলের সময় দাঁড়িয়ে, শরীরে সাবান মেখে একইভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে।’
এছাড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসককে দিয়ে ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি তিন বছরে একবার এবং ৪০ বছর পার হলে প্রতিবছর একবার স্তন পরীক্ষা করানো উচিত।
এর বাইরে চিকিৎসকের পরামর্শে ম্যামোগ্রাফি এবং রেডিওলজি ও ইমেজিং পরীক্ষা (আলট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই) করা যেতে পারে। এসব পরীক্ষায় কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে এফএনএসি অথবা কোর বায়োপসি করে রোগ শনাক্ত করা হয়।
তিনি বলেন, স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা করা গেলে ও দ্রুত চিকিৎসা নিলে বাকি জীবন সুস্থ থাকা সম্ভব। তাই মেয়েদের নিজের স্তন পরীক্ষা করার অভ্যাস করতে হবে।
অন্য দেশের মতো নারীদের স্তন ক্যান্সার আমাদের দেশেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সূচনায় চিহ্নিত করতে পারলে এ রোগ নিরাময় করা সম্ভব।
তিনি বলেন, বয়স ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে, কম বয়সে ঋতুমতী হওয়া অথবা দেরিতে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া, পরিবারে কারো স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে, ৩০ বছর বয়সের পর প্রথম সন্তান নেয়া অথবা বন্ধ্যাত্ব, স্থূলতা, চর্বিজাতীয় খাদ্য বেশি বেশি গ্রহণ ও শাকসবজি কম খাওয়া, শিশুকে বুকের দুধ পান না করানো হলে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।