স্বাস্থ্য

স্ট্রোক প্রতিরোধে মানুষের ইচ্ছাশক্তি কত বড় ভূমিকা পালন করে!

ডা. আহমেদ হোসেন চৌধুরী (হারুন) : স্ট্রোক ব্রেইনের একটি রোগ, যা প্রতিরোধ করা যায়। স্ট্রোক একটি নন-কমিউনিকেবল

ডা. আহমেদ হোসেন চৌধুরী (হারুন) : স্ট্রোক ব্রেইনের একটি রোগ, যা প্রতিরোধ করা যায়। স্ট্রোক একটি নন-কমিউনিকেবল (অসংক্রামক) রোগ অর্থাৎ যা ছোঁয়াচে নয়।

স্ট্রোক একটি রোগসম্পর্কিত লক্ষণ (ক্লিনিক্যাল সিনড্রোম)। এটি ব্রেইনের নিউরন বা কোষের কর্মহীন অবস্থা, যা ব্রেইনের রক্তনালির সংকোচন বা রক্তনালির রক্তক্ষরণের কারণে সংঘটিত হয়। এতে মস্তিষ্কের কোনো অংশ অথবা পুরো অংশ কর্মহীন হয়ে পড়ে। যা ২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় অথবা রোগী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।

স্ট্রোকসম্পর্কিত কিছু তথ্য

অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ যেমন—ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ১১-১২ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়।

স্ট্রোক দুই ধরনের। যথা—১. ধমনির স্ট্রোক -৯৯ শতাংশ

২. শিরার-স্ট্রোক ১ শতাংশ

ধমনির স্ট্রোকে মূলত রক্তনালির সংকোচন ৮৫ শতাংশ এবং রক্তনালির রক্তক্ষরণ ১৫ শতাংশ হয়।

স্ট্রোকের কারণ

১. অপরিবর্তনশীল কারণ—

বয়স বৃদ্ধিতে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

পুরুষের স্ট্রোক নারীদের চেয়ে বেশি হয়।

কালো জাতির (আফ্রিকান ও এশিয়ান) স্ট্রোকের ঝুঁকি সাদা জাতির (ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান) চেয়ে বেশি।

আগে আক্রান্ত হার্টের রোগীদের বা রক্তনালির রোগীদের ঝুঁকি বেশি।

বংশগত কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

২. পরিবর্তনশীল কারণ—

উচ্চ রক্তচাপ।

ডায়াবেটিস।

রক্তনালিতে চর্বি জমা যা রক্তনালিকে সংকুচিত করে।

ধূমপান, জর্দা, গুল, তামাকজাতীয় দ্রব্য বা মাদক সেবন।

ওজন বেশি থাকা।

অতিরিক্ত মদ্যপান।

রক্ত জমাট বাঁধার উপাদানের অভাব।

হার্টের ভালভের রোগ ও হার্ট অ্যাটাক থাকলে।

নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন।

অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ এবং শাকসবজি কম খাওয়া।

মানসিক অস্থিরতা কিংবা বিষণ্নতায় ভোগা।

উপোরক্ত কারণ ছাড়াও রক্তনালির অপ্রত্যাশিত অপরিপক্ব প্রসারণ (অ্যানোরিজম), শিরা ও ধমনির বিকৃত মিলন (মেলফরমেশন), টিউমার (ক্যান্সার), নিউরোসিফিলিস, রক্তনালির প্রদাহ (ভাসকুলাইটিস) ইত্যাদি কারণেও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

লক্ষণ

প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত (শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া, পুরো শরীর অবশ হয়ে যাওয়া)

কথা জড়িয়ে যাওয়া বা এফাশিয়া বা ডিসফেশিয়া।

কানে কম শোনা বা একেবারে না শোনা।

মাথা ঘুরানো, বমি বমি ভাব হওয়া।

চোখে না দেখা (কটিক্যাল ব্লাইন্ডনেস)।

হাত পা ঝিম ঝিম করা, বোধ না পাওয়া।

তীব্র মাথা ব্যথা (সাব-এরাকনোয়েড হেমোরেজ হয়)

খিঁচুনি হওয়া।

প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা

মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান অথবা এমআরআই করা।

রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তনালিতে চর্বি জমা, ডায়াবেটিসের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ ইত্যাদি সম্পর্কে জানা।

এক্স-রে ও আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে কিডনির কাজ পর্যালোচনা করা যা স্ট্রোকের অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়ে ভূমিকা রাখে।

 

 

বুকের এক্স-রে, ইসিজি ও ইকোকার্ডিওগ্রাফি করা যা স্ট্রোকের অন্যতম কারণ হার্টের রোগ সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কে জানা যায়।

 

 

সেরিব্রাল এনজিওগ্রাম যার মাধ্যমে রক্তনালির অপ্রত্যাশিত অপরিপক্ব প্রসারণ (অ্যানরিজম), শিরা ও ধমনির বিকৃত মিলন (মেলফরমেশন) সম্পর্কে জানা যায়।

রক্তের বিশেষ বিশেষ ধরনের পরীক্ষা যার মাধ্যমে রক্ত জমাট বাঁধার উপাদানের অভাব (ব্লিডিং ডিসঅর্ডার), নিউরো সিফিলিস, রক্তনালির প্রদাহ (ভাসকুলাইটিস) ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়।

চিকিৎসা

স্ট্রোকের রোগী চিকিৎসা করা উচিত স্ট্রোক ইউনিট ও আইসিইউতে অথবা নিউরোলজি বিভাগে। স্ট্রোক রোগীর কারণ ও অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া উচিত।

স্ট্রোকের রোগী অজ্ঞান হলে খাবারের জন্য এনজিটিউব (খাদ্যনালি), শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন, প্রস্রাবের জন্য ক্যাথেটার ব্যবহার করা হয়। রক্তপ্রবাহ ও অন্যান্য ওষুধ ইনজেকশন আকারে দেয়ার জন্য আইভি চ্যানেল ব্যবহার করা হয়।

 

 

স্ট্রোকের রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ব্যবহার করা হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন ব্যবহার করা হয়। ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।

স্ট্রোকের সঙ্গে হার্টের রোগ থাকলে হার্টের ওষুধ যেমন—এসপিরিন, ওয়ারফিরিন, পেনিসিলিন ইত্যাদি একসঙ্গে দিতে হয়।

 

 

হেমোরেজিক স্ট্রোকে (রক্তক্ষরণজনিত কারণে) রক্ত বের করার জন্য (বাইরের দিকে বা কটিকেল অবস্থায়) সার্জারি করতে হয়।

সাব-অ্যারাকনয়েড হেমোরেজে রোগীর চিকিৎসা আইসিইউতে করা উচিত। যেখানে সেরিব্রাল এনজিওগ্রামের মাধ্যমে রক্তনালির অপ্রত্যাশিত অপরিপক্ব প্রসারণ (অ্যানরিজম), শিরা ও ধমনির বিকৃত মিলনের (মেলফরমেশন) চিকিৎসা করা হয়। যেমন—অ্যানরিজমের জন্য কয়েলিং বা ক্লিপিং করা হয়, মেলফরমেশনের জন্য বাইপাস সার্জারি করা হয়।

 

 

স্ট্রোকের রোগীদের অনেক সময় প্যারালাইসিসের কারণে দীর্ঘদিন শুয়ে থাকতে হয় যা পালমোনারি ইডিমা (শ্বাসকষ্টের মতো অবস্থা) তৈরি করে, পিঠে বা পায়ে, কোমরে ঘা সৃষ্টি করে। সেজন্য রোগীকে ২ ঘণ্টা পরপর এপাশ-ওপাশ করে শোয়াতে হয়।

প্রতিকারের উপায়

স্ট্রোক হয়ে গেলে চিকিৎসা করে পুরোপুরি ভালো করা যতটা না কঠিন তার চেয়ে স্ট্রোক প্রতিরোধ সহজ।

স্ট্রোক প্রতিরোধে মানুষের ইচ্ছাশক্তি বড় ভূমিকা পালন করে। যেমন—উচ্চ রক্তচাপের রোগী নিয়মিত ওষুধ সেবন ও নিয়ম-নীতি মেনে জীবনযাপন করা।

 

 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ওষুধ গ্রহণ ও অন্যান্য নিয়মনীতি মেনে চলা।

ধূমপানসহ তামাক জাতীয় দ্রব্য বর্জন।

অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার ও ফাস্টফুড পরিহার করে আমিষ ও শাকসবজি বেশি বেশি করে খাওয়া।

মাদক ও অ্যালকোহল পরিহার করা।

অতিরিক্ত মানসিক দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা পরিহার করা।

পরিমিত খাবার ও পরিমিত ঘুমের অভ্যাস, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করা।

স্ট্রোক ও প্যারালাইসিস রোগে ভীত না হয়ে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। পরিবার ও প্রতিবেশীকে এ ধরনের রোগীর প্রতি আরো বেশি যত্নশীল হওয়ার মাধ্যমে রোগীর সুস্থতায় ভূমিকা রাখা উচিত। স্ট্রোক প্রতিরোধে আরো বেশি প্রচারের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সরকারি পর্যায়ে প্রতিটি হাসপাতালে স্ট্রোক ইউনিট চালুর মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও রোগীর অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি

ইউনিট প্রধান, স্ট্রোক ইউনিট,

নিউরোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

Related posts

যে উপসর্গে বুঝবেন কিডনির সমস্যা

admin

পুরুষের চেয়ে নারীরা রক্তশূন্যতায় বেশি ভোগেন যেসব কারণে

Suborna Islam

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ফলে যে ৫টি ক্ষতি হয়

Suborna Islam

Leave a Comment