ইসলাম ধর্ম

মুসলিম জাতি সুদের সাথে জড়িত সবচেয়ে বেশি

pickynews24

মুসলিম জাতি যেসব পাপের সাথে পরিচিত, তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত পাপের নাম ‘সুদ’। পরোক্ষ এবং না জানা এমন অনেক সুদের সাথে জড়িত মুসলিম জাতি, যা মূল সুদেরই অন্তর্ভুক্ত। কালের পরিক্রমায় হেলায় পুড়িয়ে দিচ্ছে ঈমান ও আমল। সরিয়ে নিচ্ছে আমাদের ইসলামী ঐতিহ্যের পথ থেকে। কেড়ে নিচ্ছে ঈমানের পাশাপাশি জাতির জীবনের সব সম্বল। যার কারণে মানুষ কষ্ট বৈ কিছু পাচ্ছে না। প্রভুর বিধান লঙ্ঘনের কারণে সুদে বিত্তশালী আরো বিত্তশালী-ই হচ্ছে, আর দরিদ্র আরো সম্বলহীন হচ্ছে। ফলে সফলতার পরিবর্তে হাহাকার ধেয়ে আসছে। জাতির সফলতার প্রতিবন্ধক ‘সুদ’। সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, তবেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে।’ (সূরা আলে ইমরান-১৩০)
ক. পারিবারিকভাবে কিছু ছোটখাটো বিষয় অনেক ক্ষেত্রে সুদ পর্যন্ত গড়ায় : আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, তা’আমালু কাল আজা-নিবি, ওয়া তা’আশারু কাল ইখও-য়ানি। অর্থ- লেনদেন করো অপরিচিতের মতো, আর তোমাদের পারস্পরিক আচরণ যেন হয় ভাইয়ের মতো। (মু’জামু লুগাতিল আরাবিয়্যা আল মা’আসিরা, প্রথম খণ্ড, ৪৮৯ পৃষ্ঠা) সংসারের বড় সন্তান পিতার পেশার হাল ধরতে মানবিকতার কারণে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে। অন্যান্য সন্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যার যার মতো কর্মস্থলে গেলে বড় সন্তানকে বিয়েশাদি দেয়ার পর স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে পিতার সম্পত্তি থেকে অন্যদের তুলনায় বেশি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যার ফলে ছোটরা আপত্তি করে বলে- তিনি আমাদের মতো একই বাবার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও বেশি পাবে কেন? বাবা-মা আগের বিষয়টি ছোটদের অবগত করলে বলে-এটি তার দায়িত্ব ছিল। ফলে বাধে ফিতনা। মিরাস হবে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী। সন্তান পেশায় যুক্ত হওয়ায় পিতা বা অভিভাবক কাজের নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেবেন। মানবিকতার কারণে সে যেমন সহযোগিতা করবে, তেমনি অভিভাবক ঈমানি তাকিদে অবশ্যই পারিশ্রমিক নির্ধারণ করবেন। বিনা পারিশ্রমিকে ব্যবসায় হালাল না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সেজন্য আল্লাহ তায়ালা আমাদের শেখাতে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘তাদের একজন (হজরত শুয়াইব আ:-এর কন্যাদ্বয়) বলল, হে বাবা! আপনি তাকে মজুর নিযুক্ত করুন। কারণ, আপনার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সে-ই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত। তিনি (শুয়াইব আ:) বললেন, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার মজুরি করবে। আর যদি তুমি ১০ বছর পূর্ণ করো, তবে সেটি তোমার ব্যাপার। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না।’ (সূরা কাসাস : ২৬-২৭)

খ. মজুদদারিতে সুদের প্রচলন ঘটছে : মজুদদারির কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সৃষ্টি হয়। গুজব উঠে- ‘অমুক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে’। তাৎক্ষণিক সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে খরিদ করে স্টকে রেখে বিক্রি করে দ্বিগুণ কিংবা তার চেয়ে বেশি দামে। নির্ধারিত মূল্যের বাকি সবটুকু অর্থই হারাম বা সুদ। কেননা, হঠাৎ দ্রব্যাদির সরবরাহ বন্ধ হওয়াতে সঙ্কট তৈরি হয়। সর্বসাধারণকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-‘হে ঈমানদাররা! নিশ্চয় পাদ্রি ও সংসার বিরাগীদের অনেকেই মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে থাকে। আর তারা আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে এবং যারা সোনা ও রুপা জমা রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না। তুমি তাদের বেদনাদায়ক আজাবের সুসংবাদ দাও। সেদিন জাহান্নামের আগুনে ওইগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে। এরপর ওইগুলো দিয়ে তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ এবং পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে, আর বলা হবে- এটি হচ্ছে ওটাই, যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন নিজেদের সঞ্চয়ের স্বাদ গ্রহণ করো।’ (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫) অন্যত্র এসেছে-‘হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবল তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসায় করা হয় তাই বৈধ।’ (সূরা নিসা-২৯) ইবনে বাজ তার বিখ্যাত ফাতাওয়ার কিতাব ফতোয়া বিন বাযে বলেন, ‘লাভ বা মুনাফার কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই; বরং বেশি ও কম লাভ করা জায়েজ। তবে বাজারে পণ্য যদি নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট মূল্যে মজুদ থাকে তাহলে বিক্রেতার জন্য মানুষকে ধোঁকা দেয়ার অধিকার নেই। তাকে অবশ্যই জানাতে হবে যে, মানুষ এই দামে বিক্রি করছে বা এই পণ্যটি অমুক দামে পাওয়া যাচ্ছে। তবে আমি আমার এই পণ্যটি এই দামে বিক্রি করতে পারব না। কেননা, এর চেয়ে বেশি দামে আমাকে কিনতে হয়েছে। কিংবা অমুক বেশি দামে বিক্রি করব না, কেননা পণ্যটি আগের কেনা থাকায় অমুক দামে বিক্রি করছি। কেউ যদি এই দামে এটি কিনতে চায় তবে কোনো সমস্যা নেই। তবে তার উচিত লোকদের বিদ্যমান বিষয়গুলো জানানো। (ফতোয়া বিন বাজ, ১৯ খণ্ড, ৫১ পৃষ্ঠা)
গ. বন্ধকী জমি আদান-প্রদান সুদের অন্তর্র্ভুক্ত : কারণ, দাতা তার জমি বা পণ্য যে পরিমাণ অর্থে প্রদান করেন, গ্রহীতা নামমাত্র কর্তন নিয়ে পুরো অর্থ ফেরত নেন। বন্ধক রাখা হয় ঋণ আদায়ের নিশ্চয়তাস্বরূপ। এতে ঋণদাতা নিশ্চিত থাকেন যে, ঋণ আদায় না করলেও বন্ধককৃত জিনিস থেকে আদায় করে নেয়া যাবে। পবিত্র কুরআনেও এর নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-‘আর যদি তোমরা সফরে থাকো এবং কোনো লেখক না পাও, তাহলে হস্তান্তরিত বন্ধক রাখবে। আর যদি তোমরা একে অন্যকে বিশ্বস্ত মনে করো তবে যাকে বিশ্বস্ত মনে করা হয় সে যেন স্বীয় আমানত আদায় করে এবং নিজ রব আল্লাহকে ভয় করে।’ (সূরা বাকারা-২৮৩) হাদিসে এসেছে, ইবনে সিরিন রহ:-এর সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘জনৈক লোক আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা:-এর কাছে জিজ্ঞেস করল, এক ব্যক্তি আমার কাছে একটি ঘোড়া বন্ধক রেখেছে। তা আমি আরোহণের কাজে ব্যবহার করেছি। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বললেন, তুমি আরোহণের মাধ্যমে এর থেকে যে উপকার লাভ করেছ তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে।’ (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, অষ্টম খণ্ড, ৬৬-পৃষ্ঠা, হাদিস-১৫০১৮)

বন্ধকী জমি থেকে বন্ধকগ্রহীতার কোনো ফায়দা হাসিল করা হারাম। এমনকি বন্ধকদাতা অনুমতি দিলেও পারবে না। কারণ বন্ধকী জমি থেকে বন্ধকগ্রহীতা কোনো ধরনের ফায়দা উপভোগ করা সুদের অন্তর্ভুক্ত, যা হারাম। (বাদায়েউস সানায়ে, ষষ্ঠ খণ্ড, ১৪৩-পৃষ্ঠা)
ঘ. প্রচলিত ব্যাংকিং খাতে অর্থ আদান-প্রদান সুদ : অবশ্য তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুদের সাথে জড়িত যেকোনো ব্যাংকে বিনিয়োগ ‘সুদ’। সার কথা হচ্ছে যে, ব্যাংক অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যবসায় খাতে। আর সেই ব্যবসায় যদি পুরোপুরি হালাল হয় তাহলে ব্যাংকিং পদ্ধতি মুসলিমদের জন্য হালাল বলা যেতে পারে। কিন্তু হালাল-হারাম নিয়ে সন্দিগ্ধ হলে ব্যবসায় হারাম। আর যা হারাম তার সহায়তা করাও হারাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘সৎকর্ম ও আল্লাহভীতিতে একে অন্যের সাহায্য করো। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।’ (সূরা মায়িদা, আয়াত-০২) ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ শতভাগ হালাল কাজে ব্যবহার হলে সুদের গুনাহ থেকে বাঁচা সম্ভব হতে পারে। বর্তমান যুগে উপার্জনের যেসব নতুন পদ্ধতি ও প্রণালী আবিষ্কৃত রয়েছে, এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, ব্যাংক প্রভৃতি। এসব বিষয়ে নিয়মনীতির জ্ঞানার্জন জরুরি হয়ে গেছে। অপর দিকে হালাল হারামে মিশ্রিত উপার্জনে না থাকে কোনো বরকত, না থাকে কোনো প্রশান্তি। সৃষ্টি হয় ফিতনা এবং অন্যায়ভাবে উপার্জনও আত্মসাৎ। আল্লামা ইবনে আবেদিন শামি বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি মারা যায় এবং তার উপার্জন অতিরিক্ত জিনিস বিক্রয় বা ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে হয়, এ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত হলে অধিক হক থাকা সত্ত্বেও এগুলো থেকে কিছুই নেবে না। তারা যদি জানে, তাহলে তারা মালিকদের কাছে তা ফেরত দেবে। অন্যথায়, তারা তা সওয়াবের আশা বাদে দান করবে, যদি সেটি তার মালিককে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব না হয়। (রদ্দুল মুখতার, ষষ্ঠ খণ্ড, ৩৮৫-পৃষ্ঠা)

ঙ. নগদ বিক্রিতে বাকি বিক্রির চেয়ে কম সুদ যদি চুক্তিহীন হয় : উদাহরণস্বরূপ, একটি পণ্য নগদ বিক্রিতে এক হাজার টাকা। আর বাকি বিক্রিতে এক হাজার ২০০ টাকা। বিক্রেতা ক্রেতাকে উল্লিখিত শর্ত দিলে ক্রেতা তা গ্রহণের পর নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হলে যদি ওই পণ্যের দাম এক টাকাও বাড়ানো হয়, তবে তা সুদে পরিণত হবে। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, দুই ধরনের বিক্রয় ব্যবস্থার মাধ্যমে (দুই ধরনের শর্তে) একই জিনিস বিক্রয় করতে রাসূলুল্লাহ সা: নিষেধ করেছেন।’ (জামে আত-তিরমিজি-১২৩১) ফুকাহায়ে কেরামের অভিমত, যদি বিক্রয়কৃত বস্তুর দামে নির্ধারিত শর্ত থাকে এবং যদি শর্তটি মূল্যের মধ্যে নির্ধারিত হয়, তাহলে বিক্রয় জায়েজ। আর যদি এটি নির্ধারিত না হয়, তাহলে বিক্রয় জায়েজ নয়। ফতোয়ায়ে আলমগিরি, তৃতীয় খণ্ড, ১৪২-পৃষ্ঠা)

Related posts

এবার হজে থাকছে না কোন বিধিনিষেধ

Suborna Islam

ইসলামে জাকাত দেওয়ার কিছু নির্দিষ্ট খাতসমূহ

Asma Akter

নামাজের সময়সূচি: ১২ জানুয়ারি ২০২৪

Asma Akter

Leave a Comment