বাংলাদেশে

বাঁশ-বেত শিল্প আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে

আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ প্রাচীন শিল্পগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। যান্ত্রিক যুগে হারিয়ে যাচ্ছে নানান শিল্প ও শিল্পকর্ম। দিন যতই যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীন ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেতশিল্প। বর্তমানে বেত ও বাঁশের তৈরি পণ্যের কদর নেই বললেই চলে। ফলে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে গ্রামীন এই কুটিরশিল্প।

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জে ১৪টি ইউনিয়নে একসময় মাঠে চাষ হতো বেত গাছ। বাড়ি ভিটেতে দেখা যেত বাঁশের বাগান। এ ছাড়াও যত্রতত্রভাবে বাড়ির আঙ্গিনা ভিটে মাঠে হামেশাই চোখে পড়তো বেতগাছ। আর সে সময়গুলোতে গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থালি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বেত ও বাঁশের তৈরি সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতেন। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত প্রায় সবখানেই চোখে পড়তো বেতের তৈরী আসবাবপত্র। এখন সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে এসব চিরচেনা চিত্র। বর্তমান সময়ে বেত শিল্প প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

এক সময় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে শত শত পরিবার এই বাঁশ বেতের তৈরি পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন তারা অন্য পেশায় চলে গেছেন। উপজেলার পাদ্রীশিবপুর ইউনিয়নের কানকি বাজার সংলগ্ন শ্রীমন্ত নদীর পাশে দেখা যায় প্রায় ১০টি পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এই কাজ করছেন। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও বাঁশ আর বেত দিয়ে বিভিন্ন রকম পণ্য তৈরি করছে।

কথা হয় প্রেম শ্রীকান্ত নামের কুটিরশিল্প তৈরি কারিগরের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্লাস্টিক ও অন্যান্য বিভিন্ন সামগ্রীর কদর বেড়ে যাওয়ার ফলে এসব কুটির শিল্পের চাহিদা এখন আর নেই বললেই চলে। এ ছাড়াও পর্যাপ্তহারে বেতের চাষ না হওয়ায় কাঁচামালের ঘাটতির কারণে বাঁশ বেতের পন্য তৈরিতে খরচ বেরেছে। বাজার দখল করেছে প্লাস্টিক ও এ্যলুমিনিয়ামের তৈরি নানা জাতের আসবাবপত্র। প্লাস্টিক পণ্য টেকসই ও স্বল্পমূল্যে পাওয়ায় সাধারণ মানুষ চাহিদা হারিয়ে ফেলেছে এসব কুটির শিল্প হতে। আমাদের এই বাঁশ বেতের তৈরি পন্য বিক্রি করে সংসার চালাতে বড় কষ্ট হয়ে যায়। দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাই এখন কঠিন। আমরা ছেলেমেয়েদের লেখা লেখাপড়া করতে পারছি না।

ভরপাশা ইউনিয়নের কৃষক বারেক হাওলাদার বলেন, বাড়ি ভিটের ঘরের কাছের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ-বেত কেটে আমরা তৈরি করতাম হরেক রকমের পণ্য। এসব বিক্রি করেই চলতো আমাদের সংসার। তবে এখনো গ্রামীণ সাপ্তাহিক হাট বাজার গুলোতে বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি খোল, চাটাই, খলুই, ধামা, টোনা, পাল্লা, মোড়া, ঝুড়ি, ঝাড়নি ও চালনসহ ইত্যাদি চোখে পড়ে।

বাকেরগঞ্জ বাস স্ট্যানে কাঁধে ঝুলিয়ে সড়কে ঘুরে ঘুরে কুটির শিল্প তৈরির আসবাবপত্র বিক্রি করতে দেখা যায় সমির নামের এক বিক্রেতাকে। ক্রেতারা তাদের পছন্দের পণ্য ক্রয় করে নিচ্ছেন। তার সাথে কথা হলে বলেন, কুটিরশিল্পের কদর কমে গেলেও বেড়েছে বাঁশের দাম। আর বেত তো চোখে পড়ে না বললেই চলে। যার ফলে বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্রের দাম আগের চেয়ে এখন একটু বেশি হবার ফলে বিক্রি কম হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, গ্রাম থেকে ঘুরে বাঁশ ও বেত কিনতে হয়। তারপর কিছুদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর রোদের শুকিয়ে বাঁশ বেত তোলার কাজ শুরু হয়। আবার রোদে শুকিয়ে বিভিন্ন রকমের রং লাগিয়ে রোদে শুকাতে হয়। এতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় চলে যায়। তারপর আবার বিক্রি করতে সপ্তাহ চলে যায়। সপ্তাহে ৫-৭ হাজার টাকা বিক্রি হলেও ধার দেনা আর লোন পরিশোধ করে সংসার চালানো দায়। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কোন সহযোগিতাও পাই না।

এমন পরিস্থিতিতে বাঁশ-বেতের জিনিপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন সংকটে পড়েছেন কারিগররা। অপরদিকে মানুষ হারাতে বসেছে গ্রামীণ এই প্রাচীন ঐতিহ্য। এভাবে প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে গেলে আগামী প্রজন্ম এগুলোর সম্পর্কে জানতে পারবে না। তাই কৃষি দপ্তরের এখন উদ্যোগ নেয়ার দরকার যাহাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাঁশ-বেতের উৎপাদন বাড়ানো যায়। পাশাপাশি কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে বাঁশ ও বেত চাষের আগ্রহী করে তোলা। না হয় সেই দিন আর বেশি বাকি নেই প্রাচীন এই ঐতিহ্য কুটির শিল্প হারিয়ে যেতে।

Related posts

কেন্দুয়ায় ঝগড়া থামাতে গিয়ে প্রতিপক্ষের মারধরে নারীর মৃত্যু

Rubaiya Tasnim

চাঁপাইনবাবগঞ্জে শহীদ মিনারে জুতা পরা অবস্থায় দেখা গেছে

Asma Akter

বিয়ের পরিকল্পনায় দুই সমকামী মাদরাসাছাত্রীর বাসাভাড়া,

Megh Bristy

Leave a Comment