টেক নিউজতথ্যপ্রযুক্তিসর্বশেষ

শিশুদের বিপদ ডেকে আনছে ফেসবুক ও ইন্টারনেট আসক্তি

Pickynews24

বর্তমানে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অধিকাংশ শিশু পর্নোগ্রাফি দেখছে। একপর্যায়ে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফল হিসেবে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ধর্ষণ, ইভটিজিং ও যৌন নির্যাতনের প্রবণতা।

শিশুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত শিশুদের সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ আসক্তি শিশু-কিশোরদের শারীরিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। এতে তাদের কর্মক্ষমতা কমছে। পড়াশোনায়ও অনীহা তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি তারা নানা ধরনের যৌনবিষয়ক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আসক্তির কারণে তরুণদের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে। ফলে আমরা দেখছি, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন ধর্ষণ মামলার আসামি হচ্ছে।

স্যার সলিমুল্ল্যাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের পেড্রিয়াটিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক শেখ জাহিদ বখস বলেন, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ছেলে ও মেয়েরা বাসায় পরিবারের অনেকের সঙ্গে মিশতে চায় না, একা থাকতে পছন্দ করে। একপর্যায়ে মানসিক রোগে ভোগে। মেজাজ খিটখিটে হয়। এ ছাড়া, আসক্ত অনেকের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ছেলেদের বিয়ের পর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে, এ আসক্তির পরিণতি মাদক থেকেও ভয়াবহ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পর্নোগ্রাফি শিশুদের ভেতরে বিকৃত মানসিকতা তৈরি করে। যৌনবিষয়ক একটি বিকৃত চিন্তা ও ধারণা তৈরি করে। বাংলাদেশে তেমন যৌনাচারের শিক্ষাব্যবস্থা নেই, তাই শিশুরা ভিডিওতে যা দেখে, স্বাভাবিক জীবনকেও সেটা মনে করে। যখন তারা এগুলো দেখে তাদের মধ্যে একটি সেক্সুয়াল ক্রাইম করার প্রবণতা বেড়ে যায়। অনেক সময় তারা না জেনেই নিজেদের এসব ক্রাইমের দিকে ঠেলে দেয়।

শিশুদের মধ্যে কেন এ আসক্তি

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৮ বছরের নিচের শিশু-কিশোররা মূলত দুটি কারণে এ ধরনের অনলাইন সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটিজ বা পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। প্রথমত, বয়সগত কারণে হরমোনের পরিবর্তন; অপরটি হচ্ছে বন্ধু-বান্ধবের প্রভাব। এ ছাড়া, আগে পর্নোগ্রাফির কনটেন্টগুলো সবাই গোপনীয়তার সঙ্গে উপভোগ করত। এখন এগুলো খোলামেলাভাবে উপভোগ করা হয়। মোবাইলে বা ল্যাপটপে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেও চলে আসে কনটেন্টগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধবিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শারীরিক পরিবর্তন এবং সঙ্গগত (বন্ধু-বান্ধব) কারণে শিশু-কিশোররা পর্নোগ্রাফি দেখায় আসক্ত হচ্ছে। এগুলো দেখে একপর্যায়ে তাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে। তখন তারা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করে যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেষ্টা করছে। যখন তারা ব্যর্থ হচ্ছে তখন জোরপূর্বক চেষ্টা করছে। ধর্ষণ, ইভটিজিং, যৌন নিপীড়নের মতো কাজে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এগুলো করতে না পারলে টাকার বিনিময়ে আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেষ্টা করছে। ফলে একদিকে যেমন তাদের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে, অন্যদিকে পড়াশোনায় অনীহা তৈরি হচ্ছে। মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হচ্ছে তারা।

খোলামেলা হচ্ছে শিশুরা, বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা

পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রায়ই অনেক অভিভাবক তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুকে (অধিকাংশই মেয়ে) নিয়ে সাইবার পুলিশের কাছে আসেন। তাদের বেশির ভাগেরই একই ধরনের অভিযোগ থাকে। মেয়েটি নিজের স্কুল বা কোচিংয়ে কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথা বলত। কথাবার্তার একপর্যায়ে তারা ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে থাকে। পরে তাদের বন্ধুরা সেসব ভিডিও নিজের বন্ধুদের মধ্যে শেয়ার, অথবা ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করে অথবা আপলোডের হুমকি দেয়।

সাইবার ক্রাইম বিষয়ক সচেতনতাধর্মী প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ার্নেস ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, গত ছয় বছরে শিশুদের সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার হার ব্যাপক বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক। ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে, যা ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় ১৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অধিকাংশ স্কুল-কলেজপড়ুয়া মেয়ে এ ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি। কিশোর-কিশোরীরা খুব সহজেই আজকাল এ ধরনের কনটেন্ট দেখতে পায়। এসব দেখে তাদের মধ্যেও এ ধরনের কাজ করার তাড়না তৈরি হয়। একপর্যায়ে নিজেদের ফ্যান্টাসি থেকে তারা খোলামেলা হয়ে ভিডিও কলে কথা বলে। এরপর তারা অপরাধের শিকার হয়। পর্নোগ্রাফির আসক্তি নীতি-নৈতিকতাকে অনেকাংশে ধ্বংস করে ফেলে। এ কারণে তারা অপরাধের শিকার হয়।

২০২২ সালের ৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহের হালুয়ারঘাটে গারো সম্প্রদায়ের দুই কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামির বয়স ১৭। পরে র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার কিশোর জানায়, সেও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ছিল। একই বছরের আগস্টে গাজীপুরের পূবাইলে এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল তার ১৬ বছরের প্রেমিকের বিরুদ্ধে। ওই প্রেমিককে গ্রেপ্তারের পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে পর্নে আসক্তির বিষয়টি উঠে আসে।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পর্নোগ্রাফি থেকে শিশুদের দূরে রাখতে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার প্রয়োজন। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করে সেটি যেন আসক্তিতে পরিণত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার সবসময় অভিভাবকদের নজরে থাকা উচিত। তাদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাসার কম্পিউটারটি ঘরের খোলামেলা জায়গায় রাখা উচিত, যাতে দেখা যায় সে কখন কী ব্যবহার করছে। এ ছাড়া, সব ডিভাইসে প্যারেন্টিং টুলস থাকে। অভিভাবকদের এ টুলস ব্যবহার করা উচিত। প্যারেন্টিং টুলসের মাধ্যমে সন্তানের ডিভাইসে কী দেখা যাবে, আর কী যাবে না, সব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন অভিভাবক।

Related posts

স্মার্টফোন ডিসকাউন্টে মিলছে বিজয়ের মাসে

Rubaiya Tasnim

নামাজ পড়ার সময় নিজে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা যাবে?

Asma Akter

ভিসার নামে প্রতারণা ফেসবুকে পরিচয়কারী

Rubaiya Tasnim

Leave a Comment