আল্লাহতায়ালা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন আর বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদকে (সা.) করেছেন সবার জন্য অনুসরণীয় ও আদর্শস্বরূপ। আমরা সবাই এটা ঠিকই জানি যে, আল্লাহতায়ালার ভালোবাসা পেতে হলে শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদের (সা.) পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়।
এ বিষয়টি আমাদের সবার জানা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু মহানবির (সা.) আদর্শ পরিপূর্ণ অনুসরণ করে চলছি না আর এর ফলেই আমরা পদে পদে বিপদগামী হচ্ছি। মহানবি (সা.) ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। ইসলামের ঘোরতর শত্রু ও কাফেরের লাশকেও তিনি (সা.) সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং তার উম্মতকেও তা করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
হাদিস পাঠে জানা যায় যে, একবার হজরত সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) ও হজরত কায়স ইবনে সাদ (রা.) কাদসিয়াতে বসা ছিলেন, তখন লোকেরা তাদের সামনে দিয়ে একটি জানাজা নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদের বলা হলো, এটা এ দেশীয় অমুসলিম জিম্মি ব্যক্তির জানাজা। তখন এই সাহাবি রাদিয়াল্লাহু আনহুগণ বললেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহর (সা.) সামনে দিয়েও একটি জানাজা যাচ্ছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলে তাকে বলা হয়েছিল, এটা তো এক ইহুদির জানাজা। তিনি ইরশাদ করেছিলেন, সে কি একজন মানুষ নয়?’ (বুখারি কিতাবুল জানায়েজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত, হাদিস নম্বর ১২৩৪)
কত চমৎকার শিক্ষাই না তিনি রেখে গেছেন। এই শিক্ষা অবলম্বন করলে কি সমাজ ও দেশে কোনো ধরনের অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে? মোটেও না। যদিও সব বিশ্বে আজ অশান্তি বিরাজ করছে। অথচ বিশ্বনবি, হজরত মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র বিশ্বময় শান্তির বার্তা নিয়েই এসেছেন। আর তিনি নিজ কর্মময় দ্বারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেনও। কিন্তু আজ সর্বত্র কেন অশান্তি? এর মূল কারণ হলো আমরা সেই মহান ও শ্রেষ্ঠ রাসুলের আদর্শ ভুলে গিয়ে জগতের মোহে ডুবে আছি আর এর ফলেই জগৎময় বিরাজ করছে বিশৃঙ্খলা আর অশান্তি। তাই বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মহানবির আদর্শ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
মহানবি (সা.) শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদের ইসলামি আদব-কায়দা শেখাতেন। সত্য ভাষণ ও সত্য কথন আর সত্যপ্রতিষ্ঠা এবং মিথ্যার প্রতি ছিল তার ঘৃণা। তিনি মিথ্যাকে সহ্যই করতে পারতেন না। আল্লাহতায়ালার তৌহিদ বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যও এটি একান্ত আবশ্যক বিষয়। আল্লাহতায়ালা শিরক ও মিথ্যা পরিহার করার বিষয়টি একই স্থানে উল্লেখ করেছেন।
এজন্য শিশুদেরও তিনি (সা.) প্রথম পাঠ এটিই দিতেন যে, সত্য কথা বল। আর পিতা-মাতাদেরও একথাই বলতেন, শিশুদের সত্য বলা শেখাও। একইভাবে প্রত্যেক নবাগত মুসলমানের জন্যও এই উপদেশই থাকতো যে, সত্যকে অবলম্বন কর, সদা সত্য বল। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য আর সন্তানদের মধ্যে এ অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি কতটা যত্নবান ছিলেন সেকথা একটি হাদিস থেকে জানা যায়।
আব্দুল্লাহ বিন আমের (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মহানবি (সা.) একবার আমাদের বাড়িতে তশরিফ নিয়ে আসেন। আমি তখন অল্প বয়স্ক বালক ছিলাম। আমি খেলার জন্য যাচ্ছিলাম তখন আমার মা বলেন, আব্দুল্লাহ এদিকে আসো! আমি তোমাকে কিছু দেবো। মহানবি (সা.) বলেন, তুমি কি আসলেই তাকে কিছু দেবে? আমার মা বলেন, নিশ্চয়, খেজুর দেবো। মহানবি (সা.) বলেন, যদি সত্যিকার অর্থে তোমার এমন ইচ্ছা না থাকত আর শুধু সন্তানকে ডেকে আনার জন্য এমনটি বলতে তাহলে তোমার মিথ্যা বলার গুনাহ হতো।’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল)
সেই অল্প বয়সেই মহানবির (সা.) এ উপদেশ শিশুর মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। এখন যে সন্তানের প্রতিপালন এমন পরিবেশে এবং এরূপ উপদেশের মধ্যে হয় সে জীবনভর কখনও মিথ্যা বলতে পারে কী? এভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত সন্তানরাই পরে বিশ্বকে সত্যপথ প্রদর্শনকারী হয়।
এরপর তিনি (সা.) বড় মনের পরিচয় দিয়ে দুঃখ-কষ্ট পেলেও সবকিছু সহ্য করতেন আর কোন চরম অপছন্দনীয় ব্যক্তিও তার (সা.) কাছে এসে গেলে তার সাথেও তিনি (সা.) কখনও দুর্ব্যবহার বা অনৈতিক আচরণ করেননি। কেউ ভুল কাজ করে বসলে তাও তিনি উত্তমভাবে সহ্য করতেন। অনেক সময় অনেক বেদুঈন, গ্রাম্য মানুষ আসতো আর তারা এমন কাজ করে বসতো, যাতে সাহাবিদের অনেক রাগ ধরতো কিন্তু মহানবি (সা.) তাদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন, কখনোই রাগ করেননি।
মহানবি (সা.) সাদা-কালো, ধনী-গরিব সবার মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরাও যদি নিজেদের জীবনে তা বাস্তবায়ন করি তবেই দেশ ও সমাজ হবে শান্তিময়। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার (সা.) সুন্নতের অনুসরণের মাধ্যমে এবং তার রেখে যাওয়া জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই আমরা তার প্রকৃত উম্মত হিসেবে দাবি করতে পারব।
এই পবিত্র ও শ্রেষ্ঠনবির (সা.) অনুসরণ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মাধ্যম আজ অবশিষ্ট নেই, যা পৃথিবীর অশান্ত মানুষকে শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় দেবে।
এ কথা শতভাগ সত্য, মহানবির (সা.) অতুলনীয় শিক্ষাই পারে সমাজকে বদলে দিয়ে শান্তিময় সমাজ গড়তে। আল্লাহপাক আমাদের এই মহান রাসুলের জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।