বিজ্ঞানবিনোদনবিশ্বভ্রমণলাইফ স্টাইলশিক্ষাসর্বশেষসারাদেশ

ন্যাট্রন হ্রদ! যেখানে কোনো প্রাণী পড়লেই পাথর হয়ে যায়।

ন্যাট্রন হ্রদ! যেখানে কোনো প্রাণী পড়লেই পাথর হয়ে যায়।

ন্যাট্রন হ্রদ! যেখানে কোনো প্রাণী পড়লেই পাথর হয়ে যায়।

তানজানিয়ার লেক ন্যাট্রন আফ্রিকার সবচেয়ে নির্মল হ্রদগুলির মধ্যে একটি। এর জলের সংস্পর্শে আসলে যেকোনো প্রাণীর চামড়া পুড়ে যায় এবং তারা সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারে না। এভাবে দীর্ঘকাল ধরে তাদের দেহ সেখানে থাকার কারণে তা পাথরে পরিণত হয়। এর সৌন্দর্যের কারণে প্রতিবছর অনেক অতিথি পাখি এখানে আসে দুর্ঘটনাবসত এদের অনেকেই মারা যায়।

ন্যাট্রন হ্রদ:

Natron লেকের ক্ষারীয় জলের pH 10.5 এর মতো এবং এটি এতই ক্ষারীয় যে এটি প্রাণীদের ত্বক এবং চোখ পুড়িয়ে ফেলতে পারে। জলের ক্ষারত্ব আসে সোডিয়াম কার্বনেট এবং অন্যান্য খনিজ থেকে যা পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে হ্রদে প্রবাহিত হয়। জলের সোডিয়াম কার্বনেট থাকার কারণে মৃতদেহগুলো পচে না।
পূর্ব আফ্রিকার ওই এলাকার দুটি ক্ষারীয় হ্রদের মধ্যে একটি হ্রদ ন্যাট্রন; অন্যটি হ্রদ বাহি। উভয় হ্রদ যা কোনো নদী বা সাগরে জল নিষ্কাশন করে না।
চাঁদের পাহাড়:
আফ্রিকার গভীর অরণ্য অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে এক ওল্ডোনিও লেঙ্গাই। হ্যাঁ, ‘চাঁদের পাহাড়’-এর সেই আগ্নেয়গিরি, যার কাছেই হিরের খনির সন্ধান পেয়েছিল শঙ্কর। কিন্তু এই আগ্নেয়গিরির কাছেই রয়েছে আরও এক বিস্ময়, যার সন্ধান শঙ্কর জানত না। শঙ্কর কেন, বাইরের পৃথিবীর কেউই তখনও এই হ্রদের কথা জানতেন না। তাঞ্জানিয়ার আরুশা অঞ্চলে পাহাড়ি উপত্যকায় বিরাট একটি হ্রদ লেক নেট্রন। যার জল যে কোনো জীবিত প্রাণীকে পাথরে পরিণত করতে পারে। না না, গ্রীক পুরাণের মেডুসা বা রামায়ণের অহল্যার মতো কোনো রূপকথার গল্প নয়। এ একেবারে জলজ্যান্ত বাস্তব। হ্রদের চারপাশে এমন অনেক পাখির দেহাবশেষ পড়ে রয়েছে আজও, যাদের দেখলে পাথরের মূর্তি ছাড়া অন্য কিছু মনে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আবিষ্কারের গল্প:
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০১৩ সাল। লেক নেট্রনের ধারে ছবি তুলতে হাজির হয়েছেন ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার নিক ব্র্যান্ড। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে তাঁর চোখে পড়ে কয়েকটা পাথরের মূর্তি। ঠিক পাখির মতো। এবং অত্যন্ত নিখুঁত সেই মূর্তি। যেন বাস্তবের কোনো পাখিই প্রস্তরমূর্তি ধারণ করেছে। কাছে গিয়ে একটি মূর্তি তুলে নিলেন নিক। আর তারপরেই অবাক হলেন। মূর্তি নয়, আসলে পাখিরই মৃতদেহ। তার শরীরের ভিতরে রক্ত-মাংসের কিছু নমুনা তখনও অবশিষ্ট রয়েছে। শুধু বাইরের অংশটাই পাথরে বদলে গিয়েছে। একটি একটি করে পাখিকে তুলে নিয়ে গাছের ডালে বসিয়ে দিলেন নিক। তারপর ক্যামেরার শাটার সরিয়ে তাদের ছবি তুললেন। গোটা ইউরোপ জুড়ে প্রদর্শশালাগুলিতে ভিড় জমে গেল সেই ছবি দেখতে। নিক এই ছবিগুলির নাম রেখেছিলেন ‘অ্যালাইভ এগেইন ইন ডেথ’।
৫৭ কিলোমিটার লম্বা, ২২ কিলোমিটার চওড়া এবং প্রায় ১০ ফুট গভীর লেক নেট্রন। অথচ দীর্ঘদিন তার অস্তিত্বের কথা জানতেনই না কেউ। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ এই হ্রদের কথা শুনেছিলেন, কিন্তু বাইরের পৃথিবীর কাছে তা ছিল একেবারে অপরিচিত। ১৯৫৪ সালে প্রথম এই হ্রদের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তাও কেবলমাত্র ফ্লেমিংগো পাখির আশ্রয়স্থল হিসাবে। বছরের সবসময় এখানে ফ্লেমিংগো পাখির দল উড়ে বেড়ায়। হ্রদের জলে খেলা করে। আর হ্রদের জলও যেন ফ্লেমিংগো পাখির গায়ের সঙ্গে মিল রেখেই কখনও গোলাপি তো কখনও টকটকে লাল। এইসবই অবাক করে রেখেছিল পর্যটকদের। এর থেকে বড়ো কোনো রহস্যের সন্ধান তাঁরা পাননি।
ফ্লেমিংগো-র বসতি:
প্রায় ২৫ লক্ষ ফ্লেমিংগো পাখির বাস এই হ্রদের আশেপাশে। লম্বা লম্বা পা ফেলে তারা ঘুরে বেড়ায়, আর জলজ ঝাঁঝি খায়। তবে হ্রদের জল অবাক করেছিল গবেষকদের। তাঁরা এই জলের নমুনা পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, প্লিস্টোসিন যুগে তৈরি হওয়া এই হ্রদের তলদেশ লাভাগঠিত। আর তার মধ্যে রয়েছে ট্রনা ও নেট্রন নামের দুটি যৌগ। এই দুই যৌগের কারণেই জলের রং লাল। শুধু তাই নয়, জলে সোডিয়ামের পরিমাণও অত্যন্ত বেশি। পিএইচ মাত্রা সবসময় ১২ অঙ্কের বেশি থাকে। ১৯৯৮ সালে স্টুয়ার্ট অ্যান্ড স্টুয়ার্ট নামের একটি কোম্পানি এই হ্রদের ধারে সোডিয়াম নিষ্কাশনের জন্য কারখানা তৈরির চেষ্টাও করে। কিন্তু রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পরিবেশকর্মীরা। কারণ, কারখানা তৈরি হলে হারিয়ে যাবে ফ্লেমিংগো-র বসতি।
হ্রদের জলের খুনে চরিত্র:
তবে তখনও অবধি হ্রদের জলের খুনে চরিত্রের কথা কেউ জানতেন না। নিকের ছবিগুলির কথা জানাজানি হতেই তাই অবাক হয়েছিলেন সকলে। এমনটাও কি বাস্তবে সম্ভব? অসম্ভব যে নয় তা ছবিগুলিই প্রমাণ করে। কিন্তু এই জল ছুঁলেই জীবিত প্রাণীর শরীর পাথর হয়ে যাবে, বিষয়টা এমন নয় বলেই মনে করছেন গবেষকরা। তাঁদের মতে, জলে সোডিয়ামের প্রভাবে ক্ষরতা এতটাই বেশি, যে কোনো জীবিত প্রাণীর চামড়া এতে পুড়ে যেতে বাধ্য। আর দীর্ঘক্ষণ জলের মধ্যে থাকলে ক্রমশ শরীরের সমস্ত কোষই মারা যেতে পারে। তখন সেইসমস্ত মৃত কোষকে পাথরের চেয়ে আলাদা কিছু মনে হবে না। নিক আসলে জলে পুড়ে যাওয়া সেইসব পাখিদেরই সন্ধান পেয়েছিলেন। তবে এর মধ্যে ফ্লেমিংগো পাখিরা কীভাবে অবাধে ঘুরে বেড়ায়, সেও এক রহস্য।
রহস্যময় এই হ্রদের টানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে যান। এখনও বসবাসের তেমন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পাহাড়ের গায়ে তাঁবু খাটিয়েই থাকেন পর্যটকরা। চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন। রক্তাভ হ্রদের উপরে ফ্লেমিংগো পাখির দল আপনাকে মুগ্ধ করবেই। কিন্তু ভুল করেও সেই জলে পা ডুবিয়ে বসবেন না। তাহলে আপনার
অবস্থাও হতে পারে নিক ব্র্যান্ডের ছবির পাখিগুলির মতোই।

Related posts

উইন্ডোজ ফোনের প্রতিশোধ গুগলের ওপর

Rubaiya Tasnim

ফের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন

Megh Bristy

সাউথ কোরিয়ায় নাগরিকদের বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার আহ্বান কিমের

Suborna Islam

Leave a Comment