বাংলাদেশে

রসের নেশা রাঙ্গা গাছির

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার পুটিমারী এলাকার রাঙ্গা গাছি প্রায় ৬০ বছর ধরে শীত মৌসুমে খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে আসছেন। পারিবারিক চাপ ও শারীরিক অক্ষমতা থাকলেও তিনি ওই পেশা থেকে বের হয়ে আসতে পারেন নি।

৭২ বছর বয়সী রাঙ্গা গাছির আসল নাম মো. মোমিন উদ্দীন শেখ। তার বাবা আকিজ উদ্দীন শেখও ছিলেন একজন গাছী। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে ওই পেশাটি শিখেছেন তিনি।

মোমিন বলেন, ‘আমার যখন বয়স ৯ বছর, তখন আমি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা শুরু করি। সেই কাল থেকে এ পর্যন্ত কোন শীত মৌসুমে খেজুর গাছ কাটা থেকে আমি বিরত থাকিনি। আমার সন্তানরা এখন বড় হয়ে গেছে, তারা রোজগার করে। আমার বয়স বেশি হয়ে যাওয়ায়, তারা খেজুর গাছ কাটা থেকে বিরত থাকতে বলে।

‘অনেক বার গাছ থেকে পড়ে গেছি, গায়ে কাঁটা ফুটেছে, শারীরিকভাবে আঘাত পেয়েছি। তবে শীতকাল আসলে আমি গাছ না কাটা থেকে বিরত থাকতে পারি না। খেজুর রস সংগ্রহ করা আমার একটি নেশা হয়ে গেছে।’

এ বছর তিনি ১০৩টি খেজুর গাছ কেটেছেন। সপ্তাহে তিন দিন রুটিন করে ওই গাছ গুলি কেটে রস সংগ্রহ করেন।

তিনি বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহের শনিবার ২২টি, মঙ্গলবার ৪০টি ও বৃহস্পতিবার ৪১টি গাছ কাটি। প্রত্যেক গাছ থেকে আধা লিটার থেকে ৮ লিটার পর্যন্ত রস পাই। এখন আমি প্রতি লিটার রস ৪০ টাকা, রোয়া গুড় ৪০০ টাকা ও ঝোলা গুড় ২০০ টাকা দরে বিক্রি করি। এই গুড় ও রস বিক্রি করে আমার প্রতি মাসে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়।’

তবে উদ্বেগ নিয়ে তিনি জানান, দিন দিন ওই এলাকায় কমে যাচ্ছে খেজুর গাছ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় একটি ইটের ভাটা ছিল। সেখানে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হত। ওই সময়ে ভাটার মালিক খেজুর গাছ বেশি কিনতেন। তখন এলাকার অনেক খেজুর গাছ কাটা পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এখনো যে গাছগুলি রয়েছে, তা অদক্ষ গাছিদের কারণে মারা যাচ্ছে। যারা নতুন করে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন, তারা গাছ নষ্ট করে ফেলেন। এতে গাছের মাথা চিকন চিকন হয়ে কয়েক বছরের মধ্যে মারা যায়। এ ছাড়া বর্তমানে এক ধরনের পোকাও খেজুর গাছে আক্রমণ করছে। তাতেও গাছ মারা যাচ্ছে।’

রসের গুনগত মান নিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬০ সালে গাছ থেকে যে মানের রস সংগ্রহ করেছি, এখনো মান একই আছে। মূলত রস মান নির্ধারণ করে গাছির দক্ষতার ওপর। ভালো মানের রস পেতে হলে, মাটির ঠিলাতে (ছোট কলস) রস সংগ্রহ করতে হবে। গাছে ঠিলা পাতানোর আগে ধান গাছের বিছালী দিয়ে পুড়িয়ে নিতে হবে, যাতে তাতে কোনো জীবাণু না থাকে।

‘পরে গাছে পাতিয়ে নেট জাল দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিতে হবে, যাতে পাখি বা বাদুর সেখানে না আসতে পারে। তাহলে ভালো মানের রস পাওয়া যাবে। তবে প্লাষ্টিকের বোতলে রস সংগ্রহ করলে, তার মান কোনোভাবেই ভালো হবে না। এ ছাড়া আকাশ মেঘলা থাকলে সেদিন রস অনেকটা ঘোলা হয়ে যায়। এ ছাড়া রাতে বৃষ্টি হলে রস একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়।’

চলতি মৌসুমে ওই গ্রামের রাঙ্গা গাছির মত আরও ১০ জন খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। তারাও প্রত্যেকে এ বছর ১০টি থেকে ৬০টি পর্যন্ত গাছ কেটেছেন। তাদের কাছ থেকে রস কিনতে হলে কমপক্ষে ১০দিন আগে সিরিয়াল দিয়ে আসতে হয়।

তবে কাউকে কাঁচা রস না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন খুলনা সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘এ বছর আমাদের দেশে নিপা ভাইরাসের ভয়বহতা বেশ বেড়েছে। আর সবাই আক্রান্ত হয়েছেন শীতকালে, কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে।’

তিনি বলেন, ‘মূলত বাদুররা রাতে খেজুর গাছের কাঁচা রস খেতে আসে। তাদের শরীরে নিপা ভাইরাস বসবাস করে। সেই কাঁচা রস পান করলে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে। তবে রস তাপ দিয়ে খেলে নিপা ভাইরাসে আক্তান্ত হওয়ার কোনো ভয় নেই।’

সিভিল সার্জন আরও বলেন, ‘নিপা ভাইরাসে সংক্রমিত হলে কোনো কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। এতে আক্তান্ত হওয়া ১০ জনের মধ্যে ৭ জনেরই মৃত্যু হয়।’

Related posts

নৌকা প্রার্থীর সভায় ভূরিভোজ গোবিন্দগঞ্জে

Rubaiya Tasnim

বরিশালে নিজ সন্তানকে বিষপান করিয়ে হত্যা

Megh Bristy

গাজীপুরে চাকরি খুঁজতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় প্রাণ গেল নারীর

Suborna Islam

Leave a Comment