বিশেষ সংবাদ

নাইয়রে নববধূরা এখন বাপের বাড়িতে

গত বছর আশ্বিন মাস থেকে চলতি বছর বছরের শ্রাবণ মাস পর্যন্ত পঞ্চগড়সহ পাশর্^বর্তী জেলায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের যত মেয়ের বিয়ে হয়েছে সেসব নববধূর অধিকাংশই এখন নিজ নিজ বাপের বাড়ি। আনুষ্ঠানিক ও লৌকিক লোকাচার রীতি মেনে বেশ ঘটা করেই তারা আসেন বাপের বাড়ি। স্বামীর মঙ্গল কামনার লক্ষ্যে ভাদ্র মাসের প্রথম তিনদিন তারা স্বামীর মুখ দর্শন করা থেকে বিরত থাকে। যে কারণে নববধূরা বিয়ের পর প্রথম ভাদ্র মাস আসার আগেই  শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে যান। শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে বাবা বাড়ির লোকজন পায়েস, নানা স্বাদের পিঠা-পুলি, মিষ্টান্ন ও ফলমূল নিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে আনতে যান।

মেয়ের বাড়ি থেকে পাঠানো মজাদার সেই খাদ্যসামগ্রী আশপাশের প্রতিবেশীদের বাড়িতে বিতরণও করেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তারাও তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে বউয়ের বাড়ির লোকজনকে সমাদর করেন। সারাদিনই  হৈচৈ আর উৎসবে মেতে ওঠে নববধূর শ্বশুরবাড়ি। ভাদ্র মাসে অনুষ্ঠিত নববধূকে বাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার এ রেওয়াজটি স্থানীয়দের কাছে ‘ভাদর কাটানি উৎসব’ নামে পরিচিত। শুধু পঞ্চগড় জেলাই নয় রংপুর বিভাগের আট জেলা ছাড়াও বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের পশ্চিম বঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের কোনো কোনো অংশে এই প্রথা বাঙালি সমাজে এখনো চালু রয়েছে।

বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও  ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব থেমে নেই। গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, বিবাহিত জীবনের প্রথম ভাদ্র মাসের এক থেকে তিন তারিখ পর্যন্ত স্বামীর মুখ দেখলে পরিবারে অমঙ্গল হবে। তা ছাড়া সাধারণত ভাদ্র মাসে এ জেলায় বিয়ের কোনো আয়োজনও চোখে পড়ে না। প্রচলিত এ প্রথাটি যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে চালু রয়েছে।
প্রথা অনুযায়ী, কনেপক্ষে শ্রাবণ মাসের দু’একদিন বাকি থাকতেই বরপক্ষের বাড়িতে সাধ্যমতো বিভিন্ন রকমের ফল, মিষ্টি, পায়েসসহ নানারকম পিঠা-পুলি নিয়ে যায়। বরপক্ষও সাধ্যমতো তাদের আপ্যায়ন করে। বাড়িতে কনে পক্ষের লোকজন আসায় চারদিকে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে।
ভাদর কাটানি মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় বিষয় না হলেও এ অঞ্চলে আবহমান কাল থেকে প্রথাটি চলে আসছে। এক সময় সম্ভ্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায় এ উৎসবকে জাঁকজমকভাবে পালন করত। তাদের এ রেওয়াজ ক্রমান্বয়ে এ অঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে। এক পর্যায়ে উৎসবটি এ অঞ্চলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
নিয়ম অনুযায়ী, কনে পক্ষ শ্রাবণ মাসের দু’একদিন বাকি থাকতেই বরপক্ষের বাড়িতে সাধ্যমতো বিভিন্ন রকমের ফল, মিষ্টি, পায়েসসহ নানা রকম পিঠা-পুলি নিয়ে যায়। বরপক্ষও সাধ্যমতো তাদের আপ্যায়ন করে। বাড়িতে কনে পক্ষের লোকজন আসায় চারদিকে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে ভাদ্র মাস। এর আগেই পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে ভাদর কাটানি উৎসব। এক সময় নববধূরা গরু-মহিষের গাড়িতে করে বাবার বাড়িতে নাইয়র যেতেন। এখন তাঁরা ট্রেন, মাইক্রোবাস, ইজিবাইকে করে বাবার বাড়ি যান। এখন আর গ্রমবাংলায় ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে,’ কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের হৃদয় পাগল করা এই গান এখন আর শোনা যায় না। নকশা করা ছবি তোলা গরুর গাড়ি চড়ে নাইয়রি মেয়ে এখন বাপের বাড়ি যায় না।

গরু গাড়ি এখন জাদুঘরে রেখে দেওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। অথচ এই অঞ্চলে একদা গরুর গাড়ির চলমান সারিবদ্ধ রূপ সৃষ্টি করত উদাসী ভাব। গাড়ির ক্যাচ ক্যাচ শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাড়িয়ালের গাাওয়া গান, গরুর খুরের সঙ্গে ওঠা ধুলি রাশি, আশপাশে বট, পাকুর, অর্জুনের শাড়ি, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকের কুঁড়েঘর, বাঁশঝাড় আবহমান বাংলার এই চিত্র এখন আর চোখে পড়ে না।
এই উৎসব পালনকারী নারীরা জানান, শ্রাবণ মাসের শেষ সপ্তাহে নববধূকে আনতে তার ছোট ভাই-বোন, বান্ধবী, নানি, চাচি, ফুফু ও প্রতিবেশীরা বরের বাড়িতে যান। এ সময় তাঁরা সামর্থ্য অনুযায়ী মুড়ি, পায়েস, নানা রকম ফলসহ মিষ্টি সঙ্গে নেন। ওই দিন বরপক্ষ তাদের সাধ্যমতো অতিথিদের আপ্যায়ন করে নববধূকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। নববধূ মা-বাবার বাড়িতে তিন দিন অথবা সাত দিন থাকেন। এর পর বরপক্ষের লোকজনও বিভিন্ন পদের খাবার নিয়ে নববধূকে আনতে যায়। সাধারণত, বিয়ের পর প্রথম ভাদ্র মাসে এই উৎসব পালন করেন নববধূরা।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আতাউর রহমান ও শাহাজুল ইসলাম বলেন, উৎসবের রীতি অনুযায়ী গত এক বছরে যত মেয়ের বিয়ে হয়েছে তারা বিয়ের প্রথম বছরের প্রথম ভাদ্রমাসের এক থেকে তিন তারিখ পর্যন্ত টানা তিনদিন স্বামীর মঙ্গল কামনায় স্বামীর মুখ দর্শন করবে না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ভাদর কাটানির কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও এ অঞ্চলের আদি প্রথা অনুযায়ী এ উৎসবটি যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। ‘নববিবাহিতা বধূ বাবার বাড়িতে মেহমান হিসেবে ঘটা করেই বাড়িতে ফিরবে এটা অনেক আনন্দের একটি বিষয়।
মানিকপীর বেংহারী ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক সেলিনা আকতার বলেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাদর কাটানি নামে কোনো উৎসব না থাকলেও নববধূরা একে কেন্দ্র করে বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকার সুযোগ পায়; আত্মীয় স্বজনদের দেখা সাক্ষাৎ হয় এটা অনেক আনন্দের।
ঘাটিয়ারপাড়া গ্রামের নববধূ শিলা আকতার বলেন, বিবাহিত জীবনের  পপ্রথম ভাদ্র মাসে ভাদর কাটানি উপলক্ষে বাবার বাড়িতে এসে অনেক ভালো লাগছে। যদিও স্বামীর সঙ্গে এই কদিন দেখা হবে না; তবে ফোনে প্রতিদিনই একাধিকবার যোগাযোগ হয়। উভয়ই উভয়ের খোঁজখবর নেই।
পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. দেলোয়ার হোসেন প্রধান জনকণ্ঠকে বলেন, ভাদর কাটানি মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো ধর্মীয় বিষয় না হলেও এ অঞ্চলে প্রথাটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এক সময় সম্ভ্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায় এ উৎসবকে জাঁকজমকভাবে পালন করত। তাদের এ রেওয়াজ ক্রমান্বয়ে এ অঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে।

Related posts

জাঁকজমকপূর্ণ দুবাই এয়ারশো শুরু হয়েছে

Rubaiya Tasnim

ঘরের ঝুলন্ত শোভা লিপস্টিক ফুল

Rishita Rupa

ডা. দীপু মনি : নির্বাচনের জন্য পেছাতে পারে বই উৎসব।

Megh Bristy

Leave a Comment