ইসলাম ধর্ম

সন্তানের জন্য প্রথম শিক্ষাগুলো কী?

সন্তান-সন্তুতি মহান আল্লাহর নেয়ামত। আবার বাবা-মার জন্য এক মহাপরীক্ষাও বটে। তাই এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সন্তানকে প্রথমেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও করণীয় বোঝাতে হবে। আর সন্তানকে প্রথম থেকে কী শেখাতে হবে, কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। সন্তানের জন্য প্রথম শিক্ষাগুলো কী?

মহান আল্লাহ তাআলার দেওয়া ধন-সম্পদের মধ্যে সন্তান-সন্তুতি অন্যতম। তাদের মাধ্যমেও আল্লাহ তাআলা বাবা-মাকে পরীক্ষা করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاعْلَمُواْ أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلاَدُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ
‘আর জেনে রাখ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অকল্যাণের সম্মুখীনকারী (মহা পরীক্ষা)। বস্তুতঃ আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাসাওয়াব।’ (সুরা আনফাল : আয়াত ২৮)

১. শিরকমুক্ত ইবাদতের কথা বলতে হবে
সন্তানকে প্রথমেই এ কথা শেখাতে হবে যে, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা যাবে না। হজরত লোকমান যেমনটি তাঁর সন্তানকে বলেছিলেন। কেননা শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম। আল্লাহ তাআলা সে কথা কুরআনে এভাবে তুলে ধরেছেন-
وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বললঃ হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৩)

২. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বাড়াতে হবে
হজরত লোকমান তার সন্তানকে মহান আল্লাহর ইলম ও কুদরতের ব্যঅপকতা এবং অতিসুক্ষ্ম বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। আল্লাহর প্রতি সব গোপন-প্রকাশ্য গোনাহ, অবিশ্বাস থেকে মুক্ত থাকতে হবে। মানুষের বিশ্বাস যেন দৃঢ় হয়, সে বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন-
يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ
‘হে সন্তান! কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়; অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর ভেতরে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে; তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন (আল্লাহর প্রতি এমন বিশ্বাস স্থাপন করা)। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।’ (সুরা লুকমান : আয়াত ১৬)

৩. কৈশোর থেকে ৬ জিনিসের শিক্ষা দেওয়া
> নামাজের শিক্ষা।
> মানুষকে ভালো বলার শিক্ষা।
> অন্যায় থেকে নিষেধ করা।
> এক্ষেত্রে সবর কর। প্রথম তিনটি কাজ করতে গিয়ে যে বিপদই আসুক না কেন, ধৈর্যের সঙ্গে তা মোকাবেলা করা। কেননা এসব বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
হে সন্তান! নামাজ প্রতিষ্ঠা কর; সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর এবং (এসব বাস্তবায়নে বিপদ আসলে) বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ।’ (সুরা লুকমান : আয়াত ১৭)
> অহংকার ও গর্ব না করার শিক্ষা
> মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা শেখানো

এ ৬ কাজের সমন্বয় সন্তানকে সত্যিকারের মানুষে পরিণত করবে। সে কারণেই প্রথম কাজ হচ্ছে- নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। অনেকের এমন সন্তান রয়েছে; যারা নামাজ পড়ে না। এ জন্য ওই সন্তানের ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

> নামাজের শিক্ষা
এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সব ঈমানদারের প্রতি সন্তানের ব্যাপারে প্রথমে দুইটি নির্দেশ করেছেন। একটি হলো- নামাজ; আর দ্বিতীয়টি হলো- পর্দা। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্তুতিদের নামাজ আদায় করতে আদেশ করবে; যখন তারা ৭ বছর বযসে পৌঁছবে। আর নামাজের জন্য তাদেরকে শাসন করবে; যখন তারা ১০ বছর বয়সে পৌঁছবে। আর তখন তাদের জন্য আলাদা বিছানা বা শয্যার ব্যবস্থা করবে।’ (আবু দাউদ, মিশকাত)

নামাজ শেখানোয় বাবা-মার করণীয়
সন্তানকে ৭ বছরে নামাজ পড়াতে হলে ৫ বছর থেকেই কুরআন শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা থাকলে ২ বছরে নামাজের জন্য প্রয়োজনীয় সুরা ও নামাজের নিয়মে অভ্যস্ত করানোও হবে সহজ। আর ৭ বছর বয়সে সন্তান নামাজের প্রতি আগ্রহী হবে। যদি ৭ বছর বয়সে এসে নামাজের নিয়ম ও সুরা শেখা না হয়; তবে সে নামাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং বাবা-মার করণীয় হচ্ছে ৫ বছর থেকেই তাকে সঙ্গে রেখে নামাজের নিয়ম ও সুরা শেখানোর চেষ্টা করা।

মনে রাখতে হবে
যে ছেলে-মেয়ের বয়স ১০ বছর কিংবা ১১/১২ বছর; নামাজ ফরজ হোক আর না হোক; ওই ছেলে-মেয়ে যদি নামাজ না পড়ে আর তা বাবা-মার জানা থাকে তবে বাবা-মার আমলনামায় নামাজ কাজা করার গোনাহ হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য
অনেক বাবা-মা নামাজ পড়ে। তাহাজ্জুদ পড়েন। কিন্তু ছেলে-মেয়ের নামাজ পড়ার কোনো খবর নেই কিংবা তারা নামাজ পড়ে কিনা সেই তদারকি নেই। এটি বাবা-মার জন্য মারাত্মক গোনাহের কাজ। শুধু এ জবাবদিহিতার কাজ না করার জন্য আল্লাহর কাছে ধরা পড়তে হবে।

এমনটি যেন না হয়
সংসার, সমাজ ও দেশ নিয়ে কাজ করায় কোনো সমস্যা নেই। অথচ নিজ পরিবার ও সন্তান নামাজ আদায় করল কিনা কিংবা পর্দা মেনে চলল কিনা; সেই ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখার সুযোগ হলো না। এমনটি যেন কোনোভাবেই না হয়।

সর্বোপরি
যাদের সন্তান বড় হয়েগেছে, তাদের জন্যও অবশ্যই কুরআন শেখানোর এবং নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই আল্লাহর আদালতে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

> মানুষকে ভালো ও মন্দের শিক্ষা
সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজে বাধা দেওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। হজরত লোকমান নিজ সন্তানকে নামাজের পরই এ বিষয়ে নসিহত করেছেন। অতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেউ অন্যায় করছে, তাতে মুখ বুঝে নিরব থাকার কোনো সুযোগ নেই। অন্যায় কাজের প্রতিবাদ না করা ঈমানহীনতার শামিল।

বিপদে ধৈর্যধারণের শিক্ষা
নামাজ পড়া, পর্দা করা, সৎকাজ ও অসৎকাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে গিয়ে যদি কেউ বিপদের সম্মুখীন হয় তাকে ধৈর্যধারণ করার শিক্ষা দিতে হবে। তবেই কৈশোর থেকে ধৈর্যশীল ও সাহসী হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে।

> অহংকার ও গর্ব না করার শিক্ষা
কোনোভাবেই কৈশোরে অহংকার ও গর্বের বিষয়ে অবগত করাতে হবে। এগুলো করা যাবে না। কেননা মহান আল্লাহ বলেন-
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৮)

> মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা শেখানো
দম্ভভরে জমিনে চলাফেরা করা যাবে না। যে কোনো বিষয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করার বিষয়টি শেখাতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ
‘পদচারণায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর এবং কন্ঠস্বর নীচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৯)

৪. বাবা-মার প্রতি দায়িত্ববোধ শেখাতে হবে
সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনকারী বাবা-মার জন্য করণীয় ও দায়িত্ববোধ শেখাতে হবে। বাবা-মার সঙ্গে আচরণ কেমন হবে। এ সম্পর্কে কুরআনুল কারিমের একাধিক স্থানে মহান আল্লাহ এ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এভাবে-
> وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ
‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দুই বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৪)

অন্য আয়াতে শিরকমুক্ত হয়ে আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের দায়িত্ববোধ কী হবে, তা তুলে ধরেছেন এভাবে বলেন শিরকমুক্ত থেকে বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব পালনে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
> وَاعْبُدُواْ اللّهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالاً فَخُورًا
‘আর ইবাদত কর আল্লাহর, তার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। বাবা-মার সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্নীয়, ইয়াতিম-মিসকিন , প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্ বিতজনকে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৩৬)

৫. সন্তান-সন্তুতি ও পরিবারের জন্য দোয়া করা
আল্লাহর কাছে নিজ নিজ সন্তান-সন্তুতির জন্য এভাবে বেশি বেশি দোয়া করার বিকল্প নেই। যেমনটি মহান আল্লাহ তাআলা শিখিয়েছেন-
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
উচ্চারণ : ‘রাব্বানা হাবলানা আযওয়াঝিনা ওয়া জুররিয়্যাতিনা কুর্রাতা আইয়ুনিও ওয়াঝআলনা লিল-মুত্তাক্বিনা ইমামা।’
অর্থ : ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রীর পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদের মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।’ (সুরা ফুরকান : আয়াত ৭৪)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি পরিবারের দায়িত্বশীল বাবা-মাকে নিজ নিজ সন্তানের প্রতি কুরআনের দিক-নির্দেশনা ও শিক্ষাগুলো যথাযথভাবে শেখানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related posts

ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা সর্বোত্তম

Asma Akter

যাদের কর্মকাণ্ড (আমল) দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই নষ্ট হয়ে গেছে

Asma Akter

নাপাক কাপড় কীভাবে ওয়াশিং মেশিনে ধৌত করে পবিত্র করতে হয়

Asma Akter

Leave a Comment